Skip to main content

কবিতা পাতা



এক আল্লাহ জিন্দাবাদ




-কাজী নজরুল ইসলাম

উহার প্রচার করুক হিংসা বিদ্বেষ আর নিন্দাবাদ;


আমরা বলিব সাম্য শান্তি এক আল্লাহ জিন্দাবাদ।


উহারা চাহুক সংকীর্ণতা, পায়রার খোপ, ডোবার ক্লেদ,


আমরা চাহিব উদার আকাশ, নিত্য আলোক, প্রেম অভেদ।


উহারা চাহুক দাসের জীবন, আমরা শহীদি দরজা চাই;


নিত্য মৃত্যু-ভীত ওরা, মোরা মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই!


ওরা মরিবেনা, যুদ্ব বাধিঁলে ওরা লুকাইবে কচুবনে,


দন্তনখরহীন ওরা তবু কোলাহল করে অঙ্গনে ।


ওরা নির্জীব; জিব নাড়ে তবু শুধূ স্বার্থ ও লোভবশে,


ওরা জিন,প্রেত, যজ্ঞ, উহারা লালসার পাঁকে মুখ ঘষে ।


মোরা বাংলার নব যৌবন,মৃত্যুর সাথে সন্তরী,


উহাদের ভাবি মাছি পিপীলিকা, মারি না ক তাই দয়া করি।


মানুষের অনাগত কল্যাণে উহারা চির অবিশ্বাসী,


অবিশ্বাসীরাই শয়তানী-চেলা ভ্রান্ত-দ্রষ্টা ভুল-ভাষী।


ওরা বলে, হবে নাস্তিক সব মানুষ, করিবে হানাহানি ।


মোরা বলি, হবে আস্তিক, হবে আল্লাহ মানুষে জানাজানি।


উহারা চাহুক অশান্তি; মোরা চাহিব ক্ষমাও প্রেম তাহার,


ভূতেরা চাহুক গোর ও শ্মশান, আমরা চাহিব গুলবাহার !


আজি পশ্চিম পৃথিবীতে তাঁর ভীষণ শাস্তি হেরি মানব


ফিরিবে ভোগের পথ ভয়ে, চাহিবে শান্তি কাম্য সব।


হুতুম প্যাচারা কহিছে কোটরে, হইবেনা আর সূর্যোদয়,


কাকে আর টাকে ঠোকরাইবেনা, হোক তার নখ চষ্ণু ক্ষয়।


বিশ্বাসী কভু বলেনা এ কথা, তারা আলো চায়, চাহে জ্যোতি;


তারা চাহে না ক এই উৎপীড়ন এই অশান্তি দূর্গতি।


দাঙ্গা বাঁধায়ে লুট করে যারা, তার লোভী , তারা গুন্ডাদল


তার দেখিবেনা আল্লাহর পথ চিরনির্ভয় সুনির্মল ।


ওরা নিশিদিন মন্দ চায় , ওরা নিশিদিন দ্বন্ধ চায়,


ভূতেরা শ্রীহীন ছন্দ চায়, গলিত শবের গন্ধ চায়!


নিত্য সজীব যৌবন যার, এস এস সেই নৌ-জোয়ান


সবক্লৈব্য করিয়েছে দূর তোমাদেরই চির আত্বদান !


ওরা কাদা ছুড়ে বাঁধা দেবে ভাবে -ওদের অস্ত্র নিন্দাবাদ,


মোরা ফুল ছড়ে মারিব ওদের, বলিব - ‘‘এক আল্লাহ জিন্দাবাদ”


আমি হব
- কাজী নজরুল ইসলাম


আমি হব সকাল বেলার পাখি


সবার আগে কুসুম-বাগে


উঠব আমি ডাকি !


সুয্যি মামা জাগার আগে


উঠব আমি জেগে,


হয়নি সকাল, ঘুমো এখন,


মা বলবেন রেগে।


বলব আমি - আলসে মেয়ে


ঘুমিয়ে তুমি থাক,


হয়নি সকাল, তাই বলে কি


সকাল হবে না ক ?


আমরা যদি না জাগি মা


কেম্‌নে সকাল হবে ?


তোমার ছেলে উঠলে গো মা


রাত পোহাবে তবে।






উমর ফারুক
-কাজী নজরুল ইসলাম


তিমির রাত্রি - 'এশা'র আযান শুনি দূর মসজিদে।


প্রিয়-হারা কার কান্নার মতো এ-বুকে আসিয়ে বিঁধে!


আমির-উল-মুমেনিন,


তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন।


তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,


বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী?


ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?


মুয়াজ্জিনের কন্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্ববান?


আবার লুটায়ে পড়ি।


'সেদিন গিয়াছে' - শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।


উমর! ফারুক! আখেরি নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু!


আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা-রাহু!


ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন!


সত্যের আলো নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ।


শুধু অঙ্গুলি-হেলনে শাসন করিতে এ জগতের


দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের


ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের ধরি


আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি!


ইসলাম - সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?


পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি।


আজ বুঝি - কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-


'মোরপরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।'


অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধুলার তখতে বসি


খেজুরপাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি


সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক' নুয়ে,


ঊর্ধ্বের যারা - পড়ছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভূঁয়ে।


শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ


করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ।


সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,


বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে।


হেরি পশ্চাতে চাহি-


তুমি চলিয়াছ রৌদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি


জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি


বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি।


দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে-


উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে!


হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন


শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন


সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো 'খবুজ' রুটি


একটি মশকে একটুকু পানি খোর্মা দু তিন মুঠি।


প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি


চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি!


মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,


সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে।


কিছুদূর যেতে উঠ হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, 'ভাই


পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই


উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে,


তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।'


...ভৃত্য দস্ত চুমি


কাঁদিয়া কহিল, 'উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি?


উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি


আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি?'


খলিফা হাসিয়া বলে,


'তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে।


রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, 'উমর! ওরে


করেনি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।'


কি দিব জওয়াব, কি করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই।


আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু, মোর অধিকার নাই।


আরাম সুখের, -মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা।


ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা।


ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,


মানুষে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী।


জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা,


কি গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দী' বিশ্ববীণা।


জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব-


অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, 'জয় জয় হে মানব।'


তুমি নির্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়,


সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয়।


মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান,


তাই মহাবীর খালদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান,


সিপাহ-সালারে ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,


বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না।


মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,


মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা - সেদিন সে বিভাবরী


নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে


মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুদাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে


কাঁদিতেছে আর দুখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,


উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকুলে চায়।


শুনিয়া সকল - কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে


বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,


বলিলে, 'এসব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের 'পরে,


আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে'।


কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,


বলিলে, 'বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা!


রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?


মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার


প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি' - চলিলে নিশীথ রাতে


পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে!


এত যে কোমল প্রাণ,


করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি ক' অপমান!


মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে


মেরেছ দোররা, মরেছে পুত্রে তোমার চোখের পরে!


ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি-


'অপরাধ করে তোরি মতো স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।'


আবু শাহমার গোরে


কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে।


খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,


'কোথায় খলিফা' কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,


একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে,


রৌদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে।


হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!


অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ,


মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই


তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই।






কান্ডারী হুশিয়ার!


-কাজী নজরুল ইসলাম






দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার


লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!


দুলিতেছে তরি, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ,


ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মৎ?


কে আছ জোয়ান হও আগুয়ান হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।


এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।


তিমির রাত্রি, মাতৃমন্ত্রী সান্ত্রীরা সাবধান!


যুগ-যুগান্ত সঞ্চিত ব্যথা ঘোষিয়াছে অভিযান।


ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান,


ইহাদের পথে নিতে হবে সাথে, দিতে হবে অধিকার।


অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরন


কান্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পন।


হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?


কান্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার


গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,


পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!


কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?


করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!


কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর,


বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর!


ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর!


উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।


ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান,


আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা, দিবে কোন্ বলিদান


আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?


দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, কান্ডারী হুশিয়ার!






আমি যদি আরব হতাম


-কাজী নজরুল ইসলাম






আমি যদি আরব হতাম মদিনারই পথ


এই পথে মোর চলে যেতেন নূর নবী হজরত।


পয়জা তাঁর লাগত এসে আমার কঠিন বুকে


আমি ঝর্ণা হয়ে গলে যেতাম অমনি পরম সুখে


সেই চিহ্ন বুকে পুরে


পালিয়ে যেতাম কোহ-ই-তুরে


সেথা দিবানিশি করতাম তার কদম জিয়ারত


মা ফাতেমা খেলত এসে আমার ধূলি লয়ে


আমি পড়তাম তার পায়ে লুটিয়ে ফুলের রেণু হয়ে


হাসান হোসেন হেসে হেসে


নাচত আমার বক্ষে এসে


চক্ষে আমার বইত নদী পেয়ে সে ন্যামত।


আমার বুকে পা ফেলে রে বীর আসহাব যত


রণে যেতেন দেহে আমার আঁকি মধুর ক্ষত


কুল মুসলিম আসত কাবায়


চলতে পায়ে দলত আমায়


আমি চাইতাম খোদার দীদার শাফায়ত জিন্নত।










আমরা সেই সে জাতি


-কাজী নজরুল ইসলাম






ধর্মের পথে শহীদ যাহারা আমরা সেই সে জাতি।


সাম্য মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।


আমরা সেই সে জাতি।।


পাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরার লাগিয়া আনিল যারা


মরুর তপ্ত বক্ষ নিঙ্গাড়ি শীতল শান্তিধারা,


উচ্চ- নীচের ভেদ ভাঙ্গি দিল সবারে বক্ষ পাতি।


আমরা সেই সে জাতি।।


কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি ক ইসলাম


সত্যে যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলিম তারি নাম।


আমির- ফকিরে ভেদ নাই সবে সব ভাই এক সাথী


আমরা সেই সে জাতি।।


নারীরে প্রথম দিয়াছি মুক্তি নর- সম অধিকার


মানুষে গড়া প্রাচীর ভাঙ্গিয়া করিয়াছি একাকার,


আঁধার রাতের বোরখা উতারি এনেছি আশায় ভাতি।


আমরা সেই সে জাতি।





কারার ঐ লৌহকপাট


-কাজী নজরুল ইসলাম






কারার ঐ লৌহকপাট,


ভেঙ্গে ফেল কর রে লোপাট,


রক্ত-জমাট শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।


ওরে ও তরুণ ঈশান,


বাজা তোর প্রলয় বিষাণ


ধ্বংস নিশান উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।


গাজনের বাজনা বাজা,


কে মালিক, কে সে রাজা,


কে দেয় সাজা মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?


হা হা হা পায় যে হাসি, ভগবান পরবে ফাঁসি,


সর্বনাশী শিখায় এ হীন তথ্য কে রে!


ওরে ও পাগলা ভোলা,


দে রে দে প্রলয় দোলা,


গারদগুলা জোরসে ধরে হেচ্‌কা টানে


মার হাঁক হায়দারী হাঁক, কাধে নে দুন্দুভি ঢাক


ডাক ওরে ডাক, মৃত্যুকে ডাক জীবন পানে।


নাচে ওই কালবোশাখী,


কাটাবী কাল বসে কি


দেরে দেখি ভীম কারার ঐ ভিত্তি নাড়ি


লাথি মার ভাঙ্গরে তালা,


যত সব বন্দী শালায়-আগুন-জ্বালা, আগুন-জ্বালা,


ফেল উপাড়ি।






বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা


-কাজী নজরুল ইসলাম






বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা


শির উঁচু করি মুসলমান।


দাওয়াত এসেছে নয়া যমানার


ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।


মুখেতে কালেমা হাতে তলোয়ার,


বুকে ইসলামী জোশ দুর্বার,


হৃদয়ে লইয়া এশক আল্লাহর


চল আগে চল বাজে বিষান।


ভয় নাই তর গলায় তাবিজ


বাঁধা যে রে তোর পাক কোরান।


নহি মোরা জীব ভোগ- বিলাসের,


শাহাদাত ছিল কাম্য মোদের,


ভিখারির সাজে খলীফা যাদের


শাসন করিল আধা জাহান-


তারা আজ পড়ে ঘুমায়ে বেহুঁশ


বাহিরে বহিছে ঝড় তুফান।


তখনো জাগিনি যখন যোহর,


ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর,


হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর


মাগরিবের আজ শুনি আজান।


জামাত শামিল হওরে এশাতে


এখনো জমাতে আছে স্থান।


শুকনো রুটিকে সম্বল ক’রে


যে ঈমান আর যে প্রানের জোরে


ফিরেছে জগত মন্থন ক’রে


সে শক্তি আজ ফিরিয়ে আন।


আল্লাহ আকবর রবে পুনঃ


কাঁপুক বিশ্ব দূর বিমান।





খেয়া-পারের তরণী


কাজী নজরুল ইসলাম






যাত্রীরা রাত্তিরে হ’তে এল খেয়া পার,


বজ্রেরি তুর্য্যে এ গর্জ্জেছে কে আবার ?


প্রলয়েরি আহ্বান ধ্বনিল কে বিষাণে


ঝঞ্ঝা ও ঘন দেয়া স্বনিল রে ঈশানে!






নাচে পাপ-সিন্ধুতে তুঙ্গ তরঙ্গ!


মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ!


নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে,


ত্রাসে কাঁপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে!






তমসাবৃতা ঘোরা “কিয়ামত” রাত্রি,


খেয়া-পারে আশা নাই ডুবিল রে যাত্রী


দমকি দমকি দেয়া হাঁকে কাঁপে দামিনী,


শিঙ্গার হুঙ্কারে থর থর যামিনী!






লঙ্ঘি এ সিন্ধুরে প্রলয়ের নৃত্যে


ওগো কার তরী ধায় নির্ভিক চিত্তে—


অবহেলি ‘ জলধির ভৈরব গর্জ্জন


প্রলয়ের ডঙ্কার ওঙ্কার তর্জ্জন!






পুণ্য পথের এ যে যাত্রীরা নিষ্পাপ,


ধর্ম্মেরি বর্ম্মে সু-রক্ষিত দিল্-সাফ!


নহে এরা শঙ্কিত বজ্র নিপাতে ও


কাণ্ডারী আহমদ তরী ভরা পাথেয়!






আবুবকর্ উসমান উমর আলী হায়দর


দাঁড়ী যে তরুণীর, নাই ওরে নাই ডর!


কাণ্ডারী এ তরীর পাকা মাঝি মাল্লা,


দাঁড়ী মুখে সারি গান — লা শরীক আল্লাহঃ!






“শাফায়ত্”-পাল-বাঁধা তরণীর মাস্তুল,


“জান্নৎ” হ’তে ফেলে হুরী রাশ্ রাশ্ ফুল!


শিরে নত স্নেহ-আঁখি মঙ্গল-দাত্রী,


গাও জোরে সারি-গান ও-পারের যাত্রী!


বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার,


ঐ হ’লো পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া পার |






বিদায় বেলায়


– কাজী নজরুল ইসলাম





তুমি অমন ক’রে গো বারে বারে জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না,


জল-ছল-ছল চোখে চেয়ো না।


ঐ কাতর কন্ঠে থেকে থেকে শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না,


শুধু বিদায়ের গান গেয়ো না।।


হাসি দিয়ে যদি লুকালে তোমার সারা জীবনের বেদনা,


আজো তবে শুধু হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদো না।


ঐ ব্যথাতুর আঁখি কাঁদো-কাঁদো মুখ


দেখি আর শুধু হেসে যাও,আজ বিদায়েরদিনে কেঁদো না।


চলার তোমার বাকী পথটুকু-


পথিক! ওগো সুদূর পথের পথিক-


হায়, অমন ক’রে ও অকর”ণ গীতে আঁখির সলিলে ছেয়ো না,


ওগো আঁখির সলিলে ছেয়ো না।।


দূরের পথিক! তুমি ভাব বুঝি


তব ব্যথা কেউ বোঝে না,


তোমার ব্যথার তুমিই দরদী একাকী,


পথে ফেরে যারা পথ-হারা,


কোন গৃহবাসী তারে খোঁজে না,


বুকে ক্ষত হ’য়ে জাগে আজো সেই ব্যথা-লেখা কি?


দূর বাউলের গানে ব্যথা হানে বুঝি শুধু ধূ-ধূ মাঠে পথিকে?


এ যে মিছে অভিমান পরবাসী! দেখে ঘর-বাসীদের ক্ষতিকে!


তবে জান কি তোমার বিদায়- কথায়


কত বুক-ভাঙা গোপন ব্যথায়


আজ কতগুলি প্রাণ কাঁদিছে কোথায়-


পথিক! ওগো অভিমানী দূর পথিক!


কেহ ভালোবাসিল না ভেবে যেন আজো


মিছে ব্যথা পেয়ে যেয়ো না






বিদায়


– কাজী নজরুল ইসলাম





আমার যাবার সময় হল দাও বিদায়


মোছ আঁখি দুয়ার খোল দাও বিদায়।।


ফোটে যে ফুল আঁধার রাতে


ঝরে ধুলায় ভোর বেলাতে।।


আমায় তারা ডাকে সাথী


আয়রে আয়


সজল করুন আঁখি তোলো দাও বিদায়


অন্ধকারে এসেছিলাম


থাকতে আঁধার যাই চলে


ক্ষনেক ভালবেসেছিলে চিরকালের নাই হলে


হল চেনা হল দেখা


নয়ন জলে রইল লেখা


দর বিরহী ডাকে কেকা বরষায়


ফাগুন স্বপন ভোলো ভোলো দাও বিদায়।






লিচু চোর


- কাজী নজরুল ইসলাম






বাবুদের তাল-পুকুরে


হাবুদের ডাল-কুকুরে


সে কি বাস করলে তাড়া,


বলি থাম একটু দাড়া।






পুকুরের ঐ কাছে না


লিচুর এক গাছ আছে না


হোথা না আস্তে গিয়ে


য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে


গাছে গো যেই চড়েছি


ছোট এক ডাল ধরেছি,






ও বাবা মড়াত করে


পড়েছি সরাত জোরে।


পড়বি পড় মালীর ঘাড়েই,


সে ছিল গাছের আড়েই।


ব্যাটা ভাই বড় নচ্ছার,


ধুমাধুম গোটা দুচ্চার


দিলে খুব কিল ও ঘুষি


একদম জোরসে ঠুসি।






আমিও বাগিয়ে থাপড়


দে হাওয়া চাপিয়ে কাপড়


লাফিয়ে ডিঙনু দেয়াল,


দেখি এক ভিটরে শেয়াল!


ও বাবা শেয়াল কোথা


ভেলোটা দাড়িয়ে হোথা


দেখে যেই আঁতকে ওঠা


কুকুরও জাড়লে ছোটা!


আমি কই কম্ম কাবার


কুকুরেই করবে সাবাড়!






‘বাবা গো মা গো’ বলে


পাঁচিলের ফোঁকল গলে


ঢুকি গিয়ে বোসদের ঘরে,


যেন প্রাণ আসলো ধড়ে!


যাব ফের? কান মলি ভাই,


চুরিতে আর যদি যাই!


তবে মোর নামই মিছা!


কুকুরের চামড়া খিঁচা


সেকি ভাই যায় রে ভুলা-


মালীর ঐ পিটুনিগুলা!


কি বলিস ফের হপ্তা!


তৌবা-নাক খপ্তা…!






সংকল্প


-কাজী নজরুল ইসলাম






থাকব না'ক বদ্ধ ঘরে


দেখব এবার জগৎটাকে


কেমন করে ঘুরছে মানুষ


যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।


দেশ হতে দেশ দেশান্তরে


ছুটছে তারা কেমন করে,


কিসের নেশায় কেমন করে


মরছে যে বীর লাখে লাখে।


কিসের আশায় করছে তারা


বরণ মরণ যন্ত্রণাকে


কেমন করে বীর ডুবুরি


সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে,


কেমন করে দুঃসাহসী


চলছে উড়ে স্বর্গপানে।


হাউই চড়ে চায় যেতে কে


চন্দ্রলোকের অচিনপুরে,


শুনব আমি, ইঙ্গিতে কোন


মঙ্গল হতে আসছে উড়ে।


পাতাল ফেড়ে নামব আমি


উঠব আমি আকাশ ফুঁড়ে,


বিশ্বজগৎ দেখব আমি


আপন হাতের মুঠোয় পুরে।






চল চল চল


-কাজী নজরুল ইসলাম






চল চল চল!


ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল


নিম্নে উতলা ধরণি তল,


অরুণ প্রাতের তরুণ দল


চল রে চল রে চল


চল চল চল।।


ঊষার দুয়ারে হানি' আঘাত


আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,


আমরা টুটাব তিমির রাত,


বাধার বিন্ধ্যাচল।


নব নবীনের গাহিয়া গান


সজীব করিব মহাশ্মশান,


আমরা দানিব নতুন প্রাণ


বাহুতে নবীন বল!


চল রে নও-জোয়ান,


শোন রে পাতিয়া কা-


মৃত্যু-তরণ-দুয়ারে দুয়ারে


জীবনের আহবান।


ভাঙ রে ভাঙ আগল,


চল রে চল রে চল


চল চল চল।।


ঊর্ধ্ব আদেশ হানিছে বাজ,


শহীদী-ঈদের সেনারা সাজ,


দিকে দিকে চলে কুচ-কাওয়াজ-


খোল রে নিদ-মহল!


কবে সে খেয়ালী বাদশাহী,


সেই সে অতীতে আজো চাহি'


যাস মুসাফির গান গাহি'


ফেলিস অশ্রুজল।


যাক রে তখত-তাউস


জাগ রে জাগ বেহুঁস।


ডুবিল রে দেখ কত পারস্য


কত রোম গ্রীক রুশ,


জাগিল তা'রা সকল,


জেগে ওঠ হীনবল!


আমরা গড়িব নতুন করিয়া


ধুলায় তাজমহল!


চল চল চল।।






রমজানের ঐ রোজার শেষে


-কাজী নজরুল ইসলাম






ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ


তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে , শোন আসমানী তাগিদ।


তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ


দে যাকাত , মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ


ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।


আজ পড়বি ঈদের নামাজ রে মন সেই সে ঈদগাহে


যে ময়দানে সব গাজী মুসলিম হয়েছে শহীদ।


ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।


আজ ভুলে যা তোর দোস্ত-দুশমণ, হাত মেলাও হাতে,


তোর প্রেম দিয়ে কর বিশ্ব নিখিল ইসলামে মুরিদ।


ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।


যারা জীবন ভরে রাখছে রোজা, নিত্য উপবাসী


সেই গরীব ইয়াতীম মিসকিনে দে যা কিছু মুফিদ


ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ


আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।


ঢাল হৃদয়ের তশতরীতে শিরনি তৌহিদের,


তোর দাওয়াত কবুল করবেন হজরত হয় মনে উম্মীদ।।


ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ


আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ।





কোরবানি


-কাজী নজরুল ইসলাম (অগ্নিবীণা)






ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।


দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খাম্‌খা ক্ষুব্ধ মন!


ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর,–


আজিকার এ খুন কোর্‌বানির!


দুম্বা-শির রুম্-বাসীর


শহীদের শির-সেরা আজি। –রহমান কি রুদ্র নন?


বাস্‍! চুপ খামোশ রোদন!


আজ শোর ওঠে জোর 'খুন দে, জান দে, শির দে বৎস' শোন!


ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।






ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।


খঞ্জর মারো গর্দানেই,


পঞ্জরে আজি দরদ নেই,


মর্দানি'ই পর্দা নেই


ডর্‌তা নেই আজ খুন্-খারাবিতে রক্ত-লুব্ধ মন!


খুনে খেল্‌ব খুন্-মাতন!


দুনো উন্মাদনাতে সত্য মুক্তি আন্‌তে যুঝ্‌র রণ।


ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।






ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।


চড়েছে খুন আজ খুনিয়ারার


মুস্‌লিমে সারা দুনিয়াটার।


'জুল্‌ফেকার' খুল্‌বে তার


দু'ধারী ধার্‌ শেরে-খোদার রক্তে-পূত-বদন!


খনে আজকে রুধ্‌ব মন!


ওরে শক্তি-হস্তে মুক্তি, শক্তি রক্তে সুপ্ত শোন্!


ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।






ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।


আস্তানা সিধা রাস্তা নয়,


'আজাদি' মেলে না পস্তানোয়!


দস্তা নয় সে সস্তা নয়!


হত্যা নয় কি মৃত্যুও? তবে রক্ত-লুব্ধ কোন্


কাঁদে-শক্তি-দুঃস্থ শোন্–






'এয়্‌ ইব্‌রাহিম্ আজ কোর্‌বানি কর শ্রেষ্ঠ পুত্রধন!'


ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।


এ তো নহে লোহু তরবারের


ঘাতক জালিম জোর্‌বারের!


কোরবানের জোর-জানের


খুন এ যে, এতে গোর্দা ঢের রে, এ ত্যাগে 'বুদ্ধ' মন!


এতে মা রাখে পুত্র পণ্!


তাই জননী হাজেরা বেটারে পরাল বলির পূত বসন!


ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।






ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।


এই দিনই 'মীনা'-ময়দানে


পুত্র-স্নেহের গর্দানে


ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে


রেখেছে আব্বা ইব্‌রাহিম্ সে আপনা রুদ্র পণ!


ছি ছি! কেঁপো না ক্ষুদ্র মন!


আজ জল্লাদ নয়, প্রহলাদ সম মোল্লা খুন-বদন!


ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।






ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।


দ্যাখ্ কেঁপেছে 'আরশ' আস্‌মানে,


মন-খুনি কি রে রাশ মানে?


ত্রাস প্রাণে?-তবে রাস্তা নে‍!


প্রলয়- বিষাণ কিয়ামতে তবে বাজাবে কোন্ বোধন?


সেকি সৃষ্টি-সংশোধন?


ওরে তাথিয়া তাথিয়া নাচে ভৈরব বাজে ডম্বরু শোন্!–


ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।






ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।


মুস্‌লিম-রণ-ডঙ্কা সে,


খুন্ দেখে করে শঙ্কা কে?


টঙ্কারে অসি ঝঙ্কারে


ওরে হুঙ্কারে, ভাঙি গড়া ভীম কারা লড়ব রণ-মরণ!


ঢালে বাজ্‌বে ঝন্-ঝনন!


ওরে সত্য মুক্তি স্বাধীনতা দেবে এই সে খুন-মোচন!


ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।






ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।


জোর চাই আর যাচ্‌না নয়


কোরবানি-দিন আজ না ওই?


বাজ্‌না কই? সাজ্‌না কই?


কাজ না আজিকে জান্ মাল দিয়ে মুক্তির উদ্ধরণ?


বল্– 'যুঝ্‌ব জান্ ভি পণ!'


ঐ খুনের খুঁটিতে কল্যাণ-কেতু, লক্ষ্য ঐ তোরণ!


আজ আল্লার নামে জান কোরবানে ঈদের পূত বোধন।


ওরে হত্যা নয় আজ 'সত্যাগ্রহ', শক্তির উদ্‌বোধন।






মামার বাড়ি


-জসীমউদদীন






আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা,


ফুল তুলিতে যাই


ফুলের মালা গলায় দিয়ে


মামার বাড়ি যাই।


মামার বাড়ি পদ্মপুকুর


গলায় গলায় জল,


এপার হতে ওপার গিয়ে


নাচে ঢেউয়ের দল।


দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে


লাল শালুকের ফুল,


রাতের বেলা চাঁদের সনে


হেসে না পায় কূল।


আম-কাঁঠালের বনের ধারে


মামা-বাড়ির ঘর,


আকাশ হতে জোছনা-কুসুম


ঝরে মাথার 'পর।


রাতের বেলা জোনাক জ্বলে


বাঁশ-বাগানের ছায়,


শিমুল গাছের শাখায় বসে


ভোরের পাখি গায়।


ঝড়ের দিনে মামার দেশে


আম কুড়াতে সুখ


পাকা জামের শাখায় উঠি


রঙিন করি মুখ।


কাঁদি-ভরা খেজুর গাছে


পাকা খেজুর দোলে


ছেলেমেয়ে, আয় ছুটে যাই


মামার দেশে চলে।






প্রতিদান


- জসীমউদদীন






আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর,


আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।


যে মোরে করিল পথের বিবাগী-


পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি,


দিঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর;


আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যেবা আমি বাঁধি তার ঘর।


আমার এ কূল ভাঙিয়াছে যেবা আমি তার কূল বাঁধি,


যে গেছে বুকে আঘাত করিয়া তার লাগি আমি কাঁদি।


যে মোরে দিয়েছে বিষে-ভরা বাণ,


আমি দেই তারে বুকভরা গান,


কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম-ভর,-


আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।


মোর বুকে যেবা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি


রঙিন ফুলের সোহাগ-জড়ানো ফুল মালঞ্চ ধরি।


যে মুখে কহে সে নিঠুরিয়া বাণী,


আমি লয়ে করে তারি মুখখানি,


কত ঠাঁই হতে কত কীযে আনি সাজাই নিরন্তর-


আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।






নিমন্ত্রণ


-জসীমউদদীন






তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমদের ছোট গাঁয়


গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;


মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি


মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,


মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়,


তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।


ছোট গাঁওখানি- ছোট নদী চলে, তারি একপাশ দিয়া,


কালো জল তার মাজিয়াছে কেবা কাকের চক্ষু নিয়া।


ঘাটের কিনারে আছে বাঁধা তরী,


পারের খবর টানাটানি করি-


বিনাসূতি মালা গাঁথিছে নিতুই এপার ওপার দিয়া;


বাঁকা ফাঁদ পেতে টানিয়া আনিছে দুইটি তীরের হিয়া।


তুমি যাবে ভাই, যাবে মোর সাথে- নরম ঘাসের পাতে,


চুম্বন রাখি অম্বরখানিরে মেজে লয়ো নিরালাতে।


তেলাকুচ-লতা গলায় পরিয়া


মেঠো ফুলে নিও আঁচল ভরিয়া,


হেথায় সেথায় ভাব করো তুমি বুনো পাখিদের সাথে,


তোমার পায়ের রঙখানি তুমি দেখিবে তাদের পাতে।


তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে, তোমারে সঙ্গ করি


নদীর ওপারে চলে যাই তবে লইয়া ঘাটের তরী


মাঠের যত না রাখাল ডাকিয়া,


তব সনে দেই মিতালি করিয়া,


ঢেলা কুড়াইয়া গড়ি ইমারত সারা দিনমান ধরি


সত্যিকারের নগর ভুলিয়া নকল নগর গড়ি।


তুমি যদি যাও – দেখিবে সেখানে মটর-লতার সনে,


সীম-আর-সীম হাত বাড়ালেই মুঠি ভরে সেইখানে।


তুমি যদি যাও সে-সব কুড়ায়ে,


নাড়ার আগুনে পোড়ায়ে পোড়ায়ে,


খাব আর যত গেঁয়ো চাষিদের ডাকিয়া নিমন্ত্রণে,


হাসিয়া হাসিয়া মুঠি মুঠি তাহা বিলাইব জনে জনে।


তুমি যদি যাও- শামুক কুড়ায়ে, খুব-খুব বড় করে


এমন একটি গাঁথিব মালা যা দেখনি কাহারো করে;


কারেও দেব না, তুমি যদি চাও


মনের খুশিতে দিয়ে দেব তাও,


গলায় পরিবে ঝুমঝুম রবে পথেরে মুখর করে,


হাসিব খেলিব গাহিব নাচিব সারাটি গেরাম ভরে।


খুব ভোর করে উঠিতে হইবে, সুয্যি উঠারও আগে,


কারেও কবি না দেখিস পায়ের শব্দে কেহ না জাগে।


রেল সড়কের ছোট খাদ ভরে


ডানকিনে মাছ কিলবিল করে;


কাদার বাঁধাল গাঁথি মাঝামাঝি জল সেঁচে আগেভাগে,


সব মাছগুলো কুড়ায়ে আনিব কাহারো জানার আগে।


ভর দুপুরেতে একরাশ কাদা আর একরাশ মাছ,


কাপড়ে জাড়ায়ে ফিরিয়া আসিব আপন বাড়ির কাছ;


'ওরে মুখ-পোড়া ওরে রে বাঁদর।'


গালি-ভরা মার অমনি আদর,


কতদিন আমি শুনি নারে ভাই, আমার মায়ের পাছ;


যাবি তুই ভাই, আমাদের গাঁয়ে যেথা ঘন কালো গাছ।


যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়,


ঘন কালো বন-মায়া মমতায় বেঁধেছে বনের বায়।


গাছের ছায়ায় বনের লতায়,


মোর শিশুকাল, লুকায়েছে হায়!


আজিকে সে-সব সরায়ে সরায়ে খুঁজিয়া লইব তায়,


যাবি তুই ভাই, যাবি মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।






কবর


-জসিম উদ্দিন






এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,


তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।


এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মতন মুখ,


পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।


এখানে ওখানে ঘুরিয়া ফিরিতে ভেবে হইতাম সারা,


সারা বাড়ি ভরি এত সোনা মোর ছড়াইয়া দিল কারা।


সোনালী ঊষায় সোনামুখে তার আমার নয়ন ভরি,


লাঙ্গল লইয়া ক্ষেতে ছুটিতাম গাঁয়ের ও-পথ ধরি।


যাইবার কালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত,


এ কথা লইয়া ভাবি-সাব মোর তামাশা করিত শত।






এমন করিয়া জানিনা কখন জীবনের সাথে মিশে,


ছোট-খাট তার হাসি-ব্যথা মাঝে হারা হয়ে গেনু দিশে।


বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা,


আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান-তলীর গাঁ।


শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু পয়সা করি দেড়ী,


পুঁতির মালা এক ছড়া নিতে কখনও হতনা দেরি।


দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে,


সন্ধ্যাবেলায় ছুটে যাইতাম শ্বশুর বাড়ির বাটে !


হেস না–হেস না–শোন দাদু সেই তামাক মাজন পেয়ে,


দাদী যে তোমার কত খুশি হোত দেখিতিস যদি চেয়ে।


নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, ‘এতদিন পরে এলে,


পথপানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখি জলে।’






আমারে ছাড়িয়া এত ব্যথা যার কেমন করিয়া হায়,


কবর দেশেতে ঘুমায়ে রয়েছে নিঝ্ঝুম নিরালায়।


হাত জোড় করে দোয়া মাঙ্ দাদু, ‘আয় খোদা, দয়াময়,


আমার দাদীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নাজেল হয়।’






তার পরে এই শুন্য জীবনে যত কাটিয়াছি পাড়ি,


যেখানে যাহারে জড়ায়ে ধরেছি সেই চলে গেছে ছাড়ি।


শত কাফনের শত কবরের অঙ্ক হৃদয়ে আঁকি


গনিয়া গনিয়া ভুল করে গনি সারা দিনরাত জাগি।


এই মোর হাতে কোদাল ধরিয়া কঠিন মাটির তলে,


গাড়িয়া দিয়াছি কতসোনা মুখ নাওয়ায়ে চোখের জলে।


মাটিরে আমি যে বড় ভালবাসি, মাটিতে লাগায়ে বুক,


আয় আয় দাদু, গলাগলি ধরে কেঁদে যদি হয় সুখ।






এইখানে তোর বাপ্জী ঘুমায়, এইখানে তোর মা,


কাঁদছিস তুই ? কি করিব দাদু, পরান যে মানে না !


সেই ফাল্গুনে বাপ তোর এসে কহিল আমারে ডাকি,


বা-জান, আমার শরীর আজিকে কি যে করে থাকি থাকি।


ঘরের মেঝেতে সপ্ টি বিছায়ে কহিলাম, বাছা শোও,


সেই শোওয়া তার শেষ শোওয়া হবে তাহা কি জানিত কেউ ?


গোরের কাফনে সাজায়ে তাহারে চলিলাম যবে বয়ে,


তুমি যে কহিলা–বা-জানেরে মোর কোথা যাও দাদু লয়ে?


তোমার কথার উত্তর দিতে কথা থেমে গেল মুখে,


সারা দুনিয়ার যত ভাষা আছে কেঁদে ফিরে গেল দুখে।


তোমার বাপের লাঙল-জোয়াল দু হাতে জড়ায়ে ধরি,


তোমার মায়ে যে কতই কাঁদিত সারা দিন-মান ভরি।


গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনো পথে যেত ঝরে,


ফাল্গুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শুনো মাঠখানি ভরে।


পথ দিয়ে যেতে গেঁয়ো-পথিকেরা মুছিয়া যাইতো চোখ,


চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।


আথালে দুইটি জোয়ান বলদ সারা মাঠ পানে চাহি,


হাম্বা রবেতে বুক ফাটাইত নয়নের জলে নাহি।


গলাটি তাদের জড়ায়ে ধরিয়া কাঁদিত তোমার মা,


চোখের জলের গহীন সায়রে ডুবায়ে সকল গাঁ।


উদাসিনী সেই পল্লীবালার নয়নের জল বুঝি,


কবর দেশের আন্ধার ঘরে পথ পেয়েছিল খুঁজি।


তাই জীবনের প্রথম বেলায় ডাকিয়া আনিল সাঁঝ,


হায় অভাগিনী আপনি পরিল মরণ-বীষের তাজ।


মরিবার কালে তোরে কাছে ডেকে কহিল, ‘বাছারে যাই,


বড় ব্যথা রল দুনিয়াতে তোর মা বলিতে কেহ নাই;


দুলাল আমার, দাদু রে আমার, লক্ষ্মী আমার ওরে,


কত ব্যথা মোর আমি জানি বাছা ছাড়িয়া যাইতে তোরে।’


ফোঁটায় ফোঁটায় দুইটি গণ্ড ভিজায়ে নয়ন-জলে,


কি জানি আশিস্ করি গেল তোরে মরণ-ব্যথার ছলে।






ক্ষণ পরে মোরে ডাকিয়া কহিল, ‘আমার কবর গায়,


স্বামীর মাথার ‘মাথাল’ খানিরে ঝুলাইয়া দিও বায়।’


সেই সে মাথাল পচিয়া গলিয়া মিশেছে মাটির সনে,


পরানের ব্যথা মরে না কো সে যে কেঁদে ওঠে ক্ষণে ক্ষণে।


জোড়-মানিকেরা ঘুমায়ে রয়েছে এইখানে তরু-ছায়,


গাছের শাখারা স্নেহের মায়ায় লুটায়ে পড়েছে গায়ে।


জোনাকি মেয়েরা সারা রাত জাগি জ্বালাইয়া দেয় আলো,


ঝিঁঝিরা বাজায় ঘুমের নুপুর কত যেন বেসে ভাল।


হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু,’রহমান খোদা, আয়,


ভেস্ত নাজেল করিও আজিকে আমার বাপ ও মায়ে।’






এইখানে তোর বু-জীর কবর, পরীর মতন মেয়ে,


বিয়ে দিয়েছিনু কাজীদের ঘরে বনিয়াদী ঘর পেয়ে।


এত আদরের বু-জীরে তাহারা ভালবাসিত না মোটে।


হাতেতে যদিও না মারিত তারে শত যে মারিত ঠোঁটে।


খবরের পর খবর পাঠাত, ‘দাদু যেন কাল এসে,


দু দিনের তরে নিয়ে যায় মোরে বাপের বাড়ির দেশে।


শ্বশুর তাহার কসাই চামার, চাহে কি ছাড়িয়া দিতে,


অনেক কহিয়া সেবার তাহারে আনিলাম এক শীতে।


সেই সোনামুখ মলিন হয়েছে, ফোটে না সেথায় হাসি,


কালো দুটি চোখে রহিয়া রহিয়া অশ্রু উঠিত ভাসি।


বাপের মায়ের কবরে বসিয়া কাঁদিয়া কাটাত দিন,


কে জানিত হায়, তাহারও পরানে বাজিবে মরণ-বীণ!


কি জানি পচানো জ্বরেতে ধরিল আর উঠিল না ফিরে,


এইখানে তারে কবর দিয়াছি দেখে যাও দাদু ধীরে।






ব্যথাতুরা সেই হতভাগিনীরে বাসে নাই কেউ ভাল,


কবরে তাহার জড়ায়ে রয়েছে বুনো ঘাসগুলি কালো।


বনের ঘুঘুরা উহু উহু করি কেঁদে মরে রাতদিন,


পাতায় পাতায় কেঁপে ওঠে যেন তারি বেদনার বীণ।


হাত জোড় করে দোয়া মাঙ দাদু,’আয় খোদা দয়াময়!।


আমার বু-জীর তরেতে যেন গো ভেস্ত নাজেল হয়।’






হেথায় ঘুমায় তোর ছোট ফুপু সাত বছরের মেয়ে,


রামধনু বুঝি নেমে এসেছিল ভেস্তের দ্বার বেয়ে।


ছোট বয়সেই মায়েরে হারায়ে কি জানি ভাবিত সদা,


অতটুকু বুকে লুকাইয়াছিল কে জানিত কত ব্যথা।


ফুলের মতন মুখখানি তার দেখিতাম যবে চেয়ে,


তোমার দাদীর মুখখানি মোর হৃদয়ে উঠিত ছেয়ে।


বুকেতে তাহারে জড়ায়ে ধরিয়া কেঁদে হইতাম সারা,


রঙিন সাঁঝেরে ধুয়ে মুছে দিত মোদের চোখের ধারা।






একদিন গেনু গজ্নার হাটে তাহারে রাখিয়া ঘরে,


ফিরে এসে দেখি সোনার প্রতিমা লুটায় পথের পরে।


সেই সোনামুখ গোলগাল হাত সকলি তেমন আছে,


কি জেনি সাপের দংশন পেয়ে মা আমার চলে গ্যাছে।


আপন হসেতে সোনার প্রতিমা কবরে দিলাম গাড়ি–


দাদু ধর–ধর–বুক ফেটে যায়, আর বুঝি নাহি পারি।


এইখানে এই কবরের পাশে, আরও কাছে আয় দাদু,


কথা ক’সনাক, জাগিয়া উঠিবে ঘুম-ভোলা মোর যাদু।


আস্তে আস্তে খুড়ে দেখ্ দেখি কঠিন মাটির তলে,


দীন দুনিয়ার ভেস্ত আমার ঘুমায় কিসের ছলে।






ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে,


এমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।


মজীদ হইছে আজান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর,


মোর জীবনের রোজকেয়ামত ভাবিতেছি কত দুর!


জোড়হাতে দাদু মোনাজাত কর্, ‘আয় খোদা, রহমান,


ভেস্ত নাজেল করিও সকল মৃত্যু-ব্যথিত প্রাণ!’






৫. আগডুম বাগডুম


-জসিম উদ্দিন






আগডুম বাগডুম


ঘোড়াডুম সাজে


ঢাকঢোল ঝাজর বাজে


বাজতে বাজতে চলল ঢুলি


ঢুলি গেল কমলাফুলি


কমলাফুলির টিয়েটা


সূর্যি মামার বিয়েটা।






আমার বাড়ি


- জসীম উদদীন






আমার বাড়ি যাইও ভোমর,


বসতে দেব পিঁড়ে,


জলপান যে করতে দেব


শালি ধানের চিঁড়ে।


শালি ধানের চিঁড়ে দেব,


বিন্নি ধানের খই,


বাড়ির গাছের কবরী কলা


গামছা বাঁধা দই।


আমা-কাঁঠালের বনের ধারে


শুয়ো আঁচল পাতি,


গাছের শাখা দুলিয়ে বাতাস


করব সারা রাতি।


চাঁদমুখে তোর চাঁদের চুমো


মাখিয়ে দেব সুখে,


তারা-ফুলের মালা গাঁথি


জড়িয়ে দেব বুকে।


গাই দোহনের শব্দ শুনি


জেগো সকাল বেলা,


সারাটা দিন তোমায় লয়ে


করব আমি খেলা।


আমার বাড়ি ডালিম গাছে


ডালিম ফুলের হাসি,


কাজলা দিঘির কাজল জলে


হাঁসগুলি যায় ভাসি।


আমার বাড়ি যাইও ভোমর,


এই বরাবর পথ,


মৌরি-ফুলের গন্ধ শুঁকে


থামিও তব রথ।






রাখালী


- জসীম উদ্‌দীন






এই গাঁয়েতে একটি মেয়ে চুলগুলি তার কালো কালো,


মাঝে সোনার মুখটি হাসে আঁধারেতে চাঁদের আলো।


রানতে বসে জল আনতে সকল কাজেই হাসি যে তার,


এই নিয়ে সে অনেক বারই মায়ের কাছে খেয়েছে মার।


সান করিয়া ভিজে চুলে কাঁখে ভরা ঘড়ার ভারে


মুখের হাসি দ্বিগুণ ছোটে কোনমতেই থামতে নারে।






এই মেয়েটি এমনি ছিল, যাহার সাথেই হত দেখা,


তাহার মুখেই এক নিমেষে ছড়িয়ে যেত হাসির রেখা


মা বলিত, বড়ুরে তুই, মিছেমিছি হাসিস্ বড়,


এ শুনেও সারা গা তার হাসির চোটে নড় নড়!


মুখখানি তার কাঁচা কাঁচা, না সে সোনার, না সে আবীর,


না সে ঈষৎ ঊষার ঠোঁটে আধ-আলো রঙিন রবির!


কেমন যেন গাল দুখানি মাঝে রাঙা ঠোঁটটি তাহার,


মাঠে ফোটা কলমি ফুলে কতকটা তার খেলে বাহার।






গালটি তাহার এমন পাতল ফুঁয়েই যেন যাবে উড়ে


দু একটি চুল এলিয়ে পড়ে মাথার সাথে রাখছে ধরে।


সাঁঝ-সকালে এ ঘর ও ঘর ফিরত যখন হেসে-খেলে;


মনে হত ঢেউয়ের জ্বলে ফুলটিরে কে গেছে ফেলে!






এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে ও পথ দিয়ে চলতে ধীরে


ওই মেয়েটির রূপের গাঙে হারিয়ে গেল কলসটিরে।


দোষ কি তাহার? ওই মেয়েটি মিছেমিছি এমনি হাসে,


গাঁয়ের রাখাল! অমন রূপে কেমনে রাকে পরাণটা সে!


এ পথ দিয়ে চলতে তাহার কোঁচার হুড়ুম যায় যে পড়ে,


ওই মেয়েটি কাছে এলে আচঁলে তার দে সে ভরে।


মাঠের হেলের নাস্তা নিতে হুকোর আগুন নিবে যে যায়,


পথ ভুলে কি যায় সে নিতে, ওই মেয়েটি রানছে যেথায়?


নিড়ের ক্ষেতে বারে বারে তেষ্টাতে প্রাণ যায় যে ছাড়ি,


ভর-দুপুরে আসে কেবল জল খেতে তাই ওদের বাড়ি!


ফেরার পথে ভুলেই সে যে আমের আঁটির বাশীটিরে,


ওদের গরের দাওয়ায় ফেলে মাঠের পানে যায় সে ফিরে।


ওই মেয়েটি বাজিয়ে তারে ফুটিয়ে তোলে গানের ব্যাথা,


রাঙা মুখের চুমোয় চুমোয় বাজে সুখের মুখর কথা!






এমনি করে দিনে দিনে লোক- লোচনের আড়াল দিয়া,


গেঁয়ো স্নেহের নানান ছলে পড়ল বাঁধা দুইটি হিয়া!


সাঁঝের বেলা ওই মেয়েটি চলত যখন গাঙের ঘাটে


ওই ছেলেটির ঘাসের বোঝা লাগত ভারি ওদের বাটে।


মাথার বোঝা নামিয়ে ফেলে গামছা দিয়ে লইত বাতাস,


ওই মেয়েটির জল-ভরনে ভাসতে ঢেউয়ে রূপের উছাস।


চেয়ে চেয়ে তাহার পানে বলত যেন মনে মনে,


জল ভর লো সোনার মেয়ে! হবে আমার বিয়ের কনে?


কলমী ফুলের নোলক দেব, হিজল ফুলের দেব মালা,


মেঠো বাঁশী বাজিয়ে তোমায় ঘুম পাড়াব, গাঁয়ের বালা!






বাঁশের কচি পাতা দিয়ে গড়িয়ে দেব নথটি নাকের,


সোনা লতায় গড়ব বালা তোমার দুখান সোনা হাতের।


ওই না গাঁয়ের একটি পাশে ছোট্র বেঁধে কুটিরখানি,


মেঝের তাহার ছড়িয়ে দেব সরষে ফুলের পাঁপড়ি আনি।


কাজলতলার হাটে গিয়ে আনব কিনে পাটের শাড়ী,


ওগো বালা! গাঁয়ের বালা! যাবে তুমি আমার বাড়ি?”






এই রুপেতে কত কথাই আসত তাহার ছোট্র মনে,


ওই মেয়েটি কলসী ভরে ফিরত ঘরে ততক্ষণে।


রুপের ভার আর বইতে নারে কাঁখখানি তার এলিয়ে পড়ে,


কোনোরুপে চলছে ধীরে মাটির ঘড়া জড়িয়ে ধরে।


রাখাল ভাবে, কলসখানি না থাকলে তার সরু কাঁখে,


রুপের ভারেই হয়ত বালা পড়ত ভেঙে পথের বাঁকে।


গাঙোন জল ছল-ছল বাহুর বাঁধন সে কি মানে,


কলস ঘিরি উঠছে দুলি’ গেঁয়ো-বালার রুপের টানে।






মনে মনে রাখাল ভাবে, “গাঁয়ের মেয়ে! সোনার মেয়ে।


তোমার কালো কেশের মত রাতের আঁধার এল ছেয়ে।


তুমি যদি বল আমায়, এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি


কলাপাতার আঁধার-ঘেরা ওই যে ছোট তোমার বাড়ি।


রাঙা দু’খান পা ফেলে যাও এই যে তুমি কঠিন পথে,


পথের কাঁটা কত কিছু ফুটতে পারে কোনমতে।


এই যে বাতাস-উতল বাতাস, উড়িয়ে নিলে বুকের বসন,


কতখন আর রুপের লহর তোমার মাঝে রইবে গোপন।


যদি তোমার পায়ের খাডু যায় বা খুলে পথের মাঝে,


অমর রুপের মোহন গানে সাঁঝের আকাশ সাজবে না যে।






আহা ! আহা ! সোনার মেয়ে ! একা একা পথে চল,


ব্যথায় ব্যথায় আমার চোখে জল যে ঝরে ছল ছল।”


এমনিতর কত কথায় সাঁঝের আকাশ হত রাঙা,


কখন হলুদ, আধ-হলুদ, আধ-আবীর মেঘ ভাঙা।


তার পরেতে আসত আঁধার ধানের ক্ষেতে, বনের বুকে,


ঘাসের বোঝা মাথায় লয়ে ফিরত রাখাল ঘরের মুখে।






সেদিন রাখাল শুনল, পথে সেই মেয়েটির হবে বিয়ে,


আসবে কালি ‘নওশা’তাহার ফুল-পাগড়ী মাথায় দিয়ে।


আজকে তাহার ‘হলদি-ফোটা’ বিয়ের গানে ভরা বাড়ি,


মেয়ে-গলার করুণ গানে কে দেয় তাহার পরাণ ফাড়ি’।


সারা গায়ে হলুদ মেখে সেই মেয়েটি করছিল সান,


কাঁচা সোনা ঢেলে যেন রাঙিয়ে দেছে তাহার গা’খানা।


চেয়ে তাহার মুখের পানে রাখাল ছেলের বুক ভেঙে যায়।


আহা ! আহা ! সোনার মেয়ে ! কেমন করে ভুললে আমায় ?






সারা বাড়ি খুশীর তুফান-কেউ ভাবে না তাহার লাগি,


মুখটি তাহার সাদা যেন খুনী মকর্দ্দমার দাগী।


অপরাধীর মতন সে যে পালিয়ে এল আপন ঘরে,


সারাটা রাত মরল ঝুরে কি ব্যথা সে বক্ষে ধরে।






বিয়ের ক’নে ছলছে আজি শ্বশুর-বাড়ি পালকী চড়ে


চলছে সাথে গাঁয়ের মোড়ল বন্ধু ভাই-এর কাঁধটি ধ’রে ।


সারাটা দিন বিয়ে বাড়ির ছিল যত কল-কোলাহল


গাঁয়ের পথে মূর্ত্তি ধরে তারাই যেন চলছে সকল।






কেউ বলিছে, মেয়ের বাপে খাওয়াল আজ কেমন কেমন,


ছেলের বাপের বিত্তি বেসাৎ আছে কি ভাই তেমন তেমন?


মেয়ে-জামাই মিলছে যেন চাঁদে চাঁদে মেলা,


সুর্য যেমন বইছে পাটে ফাগ-ছড়ান সাঁঝের বেলা!


এমনি করে কত কথাই কত জনের মনে আসে,


আশ্বিনেতে যেমনি তর পানার বহর গাঙে ভাসে।


হায়রে আজি এই আনন্দ, যাবে লয়ে এই যে হাসি,


দেখল না কেউ সেই মেয়েটির চোখদুটি যায় ব্যথায় ভাসি।


খুঁজল না কেউ গাঁয়ের রাখাল একলা কাঁদে কাহার লাগি


বিজন রাতের প্রহর থাকে তাহার সাথে ব্যথায় জাগি।






সেই মেয়েটির চলা-পথে সেই মেয়েটির গাঙের ঘাটে


একলা রাখাল বাজায় বাঁশী ব্যথার ভরা গাঁয়ের বাটে।


গভীর রাতে ভাটীর সুরে বাঁশী তাহার ফেরে উদাস


তারি সাথে কেঁপে কেঁপে কাঁদে রাতের কালো বাতাস।


করুণ করুণ-অতি করুণ বুকখানি তার উতল করে,


ফেরে বাঁশীর সুরটি ধীরে ধীরে ঘুমো গাঁয়ের ঘরে ঘরে।






“কোথায় জাগো বিরহিণী ! ত্যজি বিরল কুটিরখানি,


বাঁশীর ভরে এস এস ব্যথায় ব্যথায় পরাণ হানি।


শোন শোন দশা আমার, গহন রাতের গলা ধরি’


তোমার তরে ও নিদয়া, একা একা কেঁদে মরি।


এই যে জমাট রাতের আঁধার, আমার বাঁশী কাটি তারে,


কোথায় তুমি, কোথায় তুমি, কেঁদে মরে বারে বারে।”


ডাকছাড়া তার কান্না শুনি একলা নিশা সইতে নারে,


আঁধার দিয়ে জড়ায় তারে, হাওয়ায় দোলায় ব্যথার ভারে।






রাখাল ছেলে


- জসীম উদ্‌দীন (রাখালী)






“রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! বারেক ফিরে চাও,


বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?”






ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,


কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা,


সেথায় আছে ছোট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,


সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর রঙে নাওয়া,


সেই ঘরেতে একলা বসে ডাকছে আমার মা-


সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না।”






“রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! আবার কোথা ধাও,


পুব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও।”






“ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,


সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।


আমার সাথে করতো খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই,


সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।


চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দুখান পা,


বলছে ডেকে, ‘গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা।’


সারা মাঠের ডাক এসেছে, খেলতে হবে ভাই।


সাঁঝের বেলা কইব কথা এখন তবে যাই।’






“রাখাল ছেলে ! রাখাল ছেলে ! সারাটা দিন খেলা,


এ যে বড় বাড়াবাড়ি, কাজ আছে যে মেলা।”






কাজের কথা জানিনে ভাই, লাঙল দিয়ে খেলি


নিড়িয়ে দেই ধানের ক্ষেতের সবুজ রঙের চেলী।


রিষে বালা নুইয়ে গলা হলদে হওয়ার সুখে।


টির বোনের ঘোমটা খুলে চুমু দিয়ে যায় মুখে।


ঝাউয়ের ঝাড়ে বাজায় বাঁশী পউষ-পাগল বুড়ী,


আমরা সেথা চষতে লাঙল মুশীদা-গান জুড়ি।


খেলা মোদের গান গাওয়া ভাই, খেলা-লাঙল-চষা,


সারাটা দিন খেলতে জানি, জানিই নেক বসা’।






আসমানী


- জসীম উদ্‌দীন (এক পয়সার বাঁশী)






আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,


রহিমন্দীর ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।


বাড়ি তো নয় পাখির বাসা-ভেন্না পাতার ছানি,


একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।


একটুখানি হওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,


তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।






পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক’খান হাড়,


সাক্ষী দেছে অনাহারে কদিন গেছে তার।


মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি


থাপড়েতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।


পরণে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,


সোনালী তার গার বরণের করছে উপহাস।


ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,


সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু রাশি রাশি।


বাঁশীর মত সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,


হয়নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।






আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে


ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল-বিল-বিল করে।


ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,


সেই জলেতে রান্না খাওয়া আসমানীদের চলে।


পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়, নিতুই যে জ্বর তার,


বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।


খোসমানী আর আসমানী যে রয় দুইটি দেশে,


কও তো যাদু, কারে নেবে অধিক ভালবেসে?






ও বাবু সেলাম বারে বার


- জসীম উদ্‌দীন (পদ্মাপার)






ও বাবু সেলাম বারে বার,


আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু,


বাড়ি পদ্মা পার।


মোরা পঙ্খি মারি পঙ্খি ধরি মোরা


পঙ্কি বেইচা খাই-


মোদের সুখের সীমা নাই,


সাপের মাথার মণি লয়ে মোরা


করি যে কারবার।






এক ঘাটেতে রান্ধি-বাড়ি মোরা


আরেক ঘাটে খাই,


মোদের বাড়ি ঘর নাই;


সব দুনিয়া বাড়ি মোদের


সকল মানুষ ভাই;


মোরা, সেই ভায়েরে তালাশ করি আজি


ফিরি দ্বারে দ্বারে;


বাবু সেলাম বারে বার।






তারাবি


-জসীম উদ্‌দীন (মাটির কান্না)






তারাবি নামাজ পড়িতে যাইব মোল্লাবাড়িতে আজ,


মেনাজদ্দীন, কলিমদ্দীন, আয় তোরা করি সাজ।


চালের বাতায় গোঁজা ছিল সেই পুরাতন জুতা জোড়া,


ধুলাবালু আর রোদ লেগে তাহা হইয়াছে পাঁচ মোড়া।


তাহারি মধ্যে অবাধ্য এই চরণ দুখানি ঠেলে,


চল দেখি ভাই খলিলদ্দীন, লুন্ঠন-বাতি জ্বেলে।


ঢৈলারে ডাক, লস্কর কোথা, কিনুরে খবর দাও।


মোল্লাবাড়িতে একত্র হব মিলি আজ সার গাঁও।






গইজদ্দীন গরু ছেড়ে দিয়ে খাওয়ায়েছে মোর ধান,


ইচ্ছা করিছে থাপপড় মারি, ধরি তার দুটো কান।


তবু তার পাশে বসিয়া নামাজ পড়িতে আজিকে হবে,


আল্লার ঘরে ছোটোখাটো কথা কেবা মনে রাখে কবে!


মৈজদ্দীন মামলায় মোরে করিয়াছে ছারেখার,


টুটি টিপে তারে মারিতাম পেলে পথে কভু দেখা তার।


আজকে জামাতে নির্ভয়ে সে যে বসিবে আমার পাশে,


তাহারো ভালর তরে মোনাজাত করিব যে উচ্ছাসে।


মাহে রমজান আসিয়াছে বাঁকা রোজার চাঁদের ন্যায়,


কাইজা ফেসাদ সব ভুলে যাব আজি তার মহিমায়।


ভুমুরদি কোথা, কাছা ছাল্লাম আম্বিয়া পুঁথি খুলে,


মোর রসুলের কাহিনী তাহার কন্ঠে উঠুক দুলে।


মেরহাজে সেই চলেছেন নবী, জুমজুমে করি স্নান,


অঙ্গে পরেছে জোছনা নিছনি আদমের পিরহান।


নুহু আলায়হুছালামের টুপী পরেছেন নবী শিরে,


ইবরাহিমের জরির পাগরী রহিয়াছে তাহা ঘিরে।


হাতে বাঁধা তার কোরান-তাবিজ জৈতুন হার গলে,


শত রবিশশী একত্র হয়ে উঠিয়াছে যেন জ্বলে।


বুরহাকে চড়ে চলেছেন নবী কন্ঠে কলেমা পড়ি,


দুগ্ধধবল দূর আকাশের ছায়াপথ রেখা ধরি।


আদম ছুরাত বামধারে ফেলি চলে নবী দূরপানে,


গ্রহ-তারকার লেখারেখাহীন ছায়া মায়া আসমানে।






তারপর সেই চৌঠা আকাশ, সেইখানে খাড়া হয়ে,


মোনাজাত করে আখেরী নবীজী দুহাত উর্ধ্বে লয়ে।


এই যে কাহিনী শুনিতে শুনিতে মোল্লা বাড়ির ঘরে,


মহিমায় ঘেরা অতীত দিনেরে টানিয়া আনিব ধরে।






বচন মোল্লা কোথায় আজিকে সরু সুরে পুঁথি পড়ি,


মোর রসুলের ওফাত কাহিনী দিক সে বয়ান করি।


বিমারের ঘোরে অস্থির নবী, তাঁহার বুকের পরে,


আজরাল এসে আসন লভিল জান কবজের তরে।


আধ অচেতন হজরত কহে, এসেছ দোস্ত মোর,


বুঝিলাম আজ মোর জীবনের নিশি হয়ে গেছে ভোর


একটুখানিক তবুও বিমল করিবারে হবে ভাই!


এ জীবনে কোন ঋণ যদি থাকে শোধ করে তাহা যাই।


***


***


মাটির ধরায় লুটায় নবীজী, ঘিরিয়া তাহার লাশ,


মদিনার লোক থাপড়িয়া বুক করে সবে হাহুতাশ।


আব্বাগো বলি, কাঁদে মা ফাতিমা লুটায়ে মাটির পরে,


আকাশ ধরনী গলাগলি তার সঙ্গে রোদন করে।


এক ক্রন্দন দেখেছি আমরা বেহেস্ত হতে হায়,


হাওয়া ও আদম নির্বাসিত যে হয়েছিল ধরাছায়;


যিশু-জননীর কাঁদন দেখেছি ভেসে-র পায়া ধরে,


ক্রুশ বিদ্ধ সে ক্ষতবিক্ষত বেটার বেদন স্মরে।


আরেক কাঁদন দেখেছি আমরা নির্বাসী হাজেরার,


জমিনের পরে শেওলা জমেছে অশ্রু ধারায় তার;


সবার কাঁদন একত্রে কেউ পারে যদি মিশাবার,


ফাতিমা মায়ের কাঁদনের সাথে তুলনা মেলে না তার।






আসমান যেন ভাঙ্গিয়া পড়িল তাহার মাথায় হায়,


আব্বা বলিতে আদরিয়া কেবা ডাকিয়া লইবে তায়।


গলেতে সোনার হারটি দেখিয়া কে বলিবে ডেকে আর,


নবীর কনের কন্ঠে মাতাগো এটি নহে শোভাদার।


সেই বাপজান জনমের মত গিয়াছে তাহার ছাড়ি।


কোন সে সুদূর গহন আঁধার মরণ নদীর পাড়ি।


জজিরাতুল সে আরবের রাজা, কিসের অভাব তার,


তবু ভুখা আছে চার পাঁচদিন, মুছাফির এলো দ্বার।


কি তাহারে দিবে খাইবারে নবী, ফাতেমার দ্বারে এসে;


চারিটি খোরমা ধার দিবে মাগো কহে এসে দীন বেশে।


সে মাহভিখারী জনমের মত ছাড়িয়া গিয়াছে তায়,


আব্বাগো বলি এত ডাক ডাকে উত্তর নাহি হায়।


এলাইয়া বেশ লুটাইয়া কেশ মরুর ধূলোর পরে,


কাঁদে মা ফাতেমা, কাঁদনে তাহার খোদার আরশ নড়ে।


কাঁদনে তাহার ছদন সেখের বয়ান ভিজিয়া যায়,


গৈজদ্দীন পিতৃ-বিয়োগ পুন যেন উথলায়!


খৈমুদ্দীন মামলায় যারে করে ছিল ছারেখার,


সে কাঁদিছে আজ ফাতিমার শোকে গলাটি ধরিয়া তার।


মোল্লাবাড়ির দলিজায় আজি সুরা ইয়াসিন পড়ি,


কোন দরবেশ সুদূর আরবে এনেছে হেথায় ধরি।


হনু তনু ছমু কমুরে আজিকে লাগিছে নূতন হেন,


আবুবক্কর ওমর তারেখ ওরাই এসেছে যেন।


সকলে আসিয়া জামাতে দাঁড়াল, কন্ঠে কালাম পড়ি,


হয়ত নবীজী দাঁড়াল পিছনে ওদেরি কাতার ধরি।


ওদের মাথার শত তালী দেওয়া ময়লা টুপীর পরে,


দাঁড়াইল খোদা আরশ কুরছি ক্ষনেক ত্যাজ্য করে।






***






মোল্লাবাড়িতে তারাবি নামাজ হয় না এখন আর,


বুড়ো মোল্লাজি কবে মারা গেছে, সকলই অন্ধকার।


ছেলেরা তাহার সুদূর শহরে বড় বড় কাজ করে,


বড় বড় কাজে বড় বড় নাম খেতাবে পকেট ভরে।


সুদূর গাঁয়ের কি বা ধারে ধার, তারাবি জামাতে হায়,


মোমের বাতিটি জ্বলিত, তাহা যে নিবেছে অবহেলায়।


বচন মোল্লা যক্ষ্মা রোগেতে যুঝিয়া বছর চার,


বিনা ঔষধে চিকিৎসাহীন নিবেছে জীবন তার।


গভীর রাত্রে ঝাউবনে নাকি কন্ঠে রাখিয়া হায়,


হোসেন শহিদ পুঁথিখানি সে যে সুর করে গেয়ে যায়।


ভুমুরদি সেই অনাহারে থেকে লভিল শূলের ব্যথা,


চীৎকার করি আছাড়ি পিছাড়ি ঘুরিতে যে যথা তথা।


তারপর সেই অসহ্য জ্বালা সহিতে না পেরে হায়,


গলে দড়ি দিয়ে পেয়েছে শানি- আম্রগাছের ছায়।


কাছা ছাল্লাম পুঁথিখানি আজো রয়েছে রেহেল পরে,


ইদুরে তাহার পাতাগুলি হায় কেটেছে আধেক করে।


লঙ্কর আজ বৃদ্ধ হয়েছে, চলে লাঠিভর দিয়ে,


হনু তনু তারা ঘুমায়েছে গায়ে গোরের কাফন নিয়ে।






সারা গ্রামখানি থম থম করে স্তব্ধ নিরালা রাতে;


বনের পাখিরা আছাড়িয়া কাঁদে উতলা বায়ুর সাথে।


কিসে কি হইল, কি পাইয়া হায় কি আমরা হারালাম,


তারি আফসোস শিহরি শিহরি কাঁপিতেছে সারা গ্রাম।


ঝিঁঝিরা ডাকিছে সহস্র সুরে, এ মূক মাটির ব্যথা,


জোনাকী আলোয় ছড়ায়ে চলিছে বন-পথে যথা তথা।






১. মাস্টার বাবু


-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর






আমি আজ কানাই মাস্টার,


বড় মোর বেড়াল ছানাটি


আমি ওকে মারি নে মা বেত,


মিছিমিছি বসি নিয়ে কাঠি।


রোজ রোজ দেরি করে আসে,


পড়াতে দেয় না ও তো মন,


ডান পা তুলিয়ে তোলে হাই,


যত আমি বলি 'শোন, শোন'।


দিনরাত খেলা খেলা খেলা,


লেখা পড়ায় ভারি অবহেলা।


আমি বলি 'চ ছ জ ঝ ঞ'


ও কেবল বলে 'মিয়ো, মিয়ো'।


প্রথম ভাগের পাতা খুলে


আমি ওরে বোঝাই মা কত-


চুরি করে খাস নে কখনে,


ভাল হোস গোপালের মতো।


যত বলি সব হয় মিছে,


কথা যদি একটাও শোনে-


মাছ যদি দেখেছে কোথাও


কিছুই থাকে না আর মনে।


চড়াই পাখির দেখা পেলে


ছুটে যায় সব পড়া ফেলে।


যত বলি 'চ ছ জ ঝ ঞ'


দুষ্টামি করে বলে 'মিয়ো'।


আমি ওরে বলি বার বার


'পড়ার সময় তুমি পড় -


তার পরে ছুটি হয়ে গেলে


খেলার সময় খেলা কোরো'।


ভাল মানুষের মত থাকে,


আড়ে আড়ে চায় মুখপানে,


এমনি সে ভান করে যেন


যা বলি বুঝেছে তার মানে।


একটু সুযোগা বোঝে যেই


কোথা যায় আর দেখা নেই।


আমি বলি 'চ ছ জ ঝ ঞ',


ও কেবল বলে 'মিয়ো মিয়ো'।।






তালগাছ


-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর






তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে


সব গাছ ছাড়িয়ে


উঁকি মারে আকাশে।


মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়,


একেবারে উড়ে যায়;


কোথা পাবে পাখা সে?


তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে


গোল গোল পাতাতে


ইচ্ছাটি মেলে তার, -


মনে মনে ভাবে, বুঝি ডানা এই,


উড়ে যেতে মানা নেই


বাসাখানি ফেলে তার।


সারাদিন ঝরঝর থত্থর


কাঁপে পাতা-পত্তর,


ওড়ে যেন ভাবে ও,


মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে


তারাদের এড়িয়ে


যেন কোথা যাবে ও।


তার পরে হাওয়া যেই নেমে যায়,


পাতা কাঁপা থেমে যায়,


ফেরে তার মনটি


যেই ভাবে, মা যে হয় মাটি তার


ভালো লাগে আরবার


পৃথিবীর কোণটি।






সহজ পাঠ, প্রথম ভাগ


-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর






আলো হয় ,গেল ভয়


জয়লাল ধরে হাল ।






চারি দিক, ঝিকি মিক্‌


অবিনাশ, কাটে ঘাস ।






বায়ু বয় বনময়


ঝাউডাল দেয় তাল






বাঁশ গাছ করে নাচ ।


বুড়ি দাই জাগে নাই ।






দীঘিজল ঝল মল ।


হরিহর বাঁধে ঘর ।






যত কাক দেয় ডাক ।


পাতু পাল আনে চাল ।






খুদিরাম পাড়ে জাম ।


দীননাথ, রাঁধে ভাত ।






মধু রায় খেয়া বায় ।


গুরুদাস করে চাষ ।






দুরন্ত আশা,


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর






মর্মে যবে মত্ত আশা সর্পসম ফোঁসে,


অদৃষ্টের বন্ধনেতে দাপিয়া বৃথা রোষে,


তখনো ভালোমানুষ সেজে বাঁধানো হুঁকা যতনে মেজে


মলিন তাস সজোরে ভেঁজে খেলিতে হবে কষে!


অন্নপায়ী বঙ্গবাসী স্তন্যপায়ী জীব


জন-দশেকে জটলা করি তক্তপোশে ব’সে।






ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো, পোষ-মানা এ প্রাণ


বোতাম-আঁটা জামার নীচে শান্তিতে শয়ান।


দেখা হলেই মিষ্ট অতি মুখের ভাব শিষ্ট অতি,


অলস দেহ ক্লিষ্টগতি— গৃহের প্রতি টান।


তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু নিদ্রারসে ভরা,


মাথায় ছোটো বহরে বড়ো বাঙালি সন্তান।






ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুয়িন!


চরণতলে বিশাল মরু দিগন্তে বিলীন।


ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি,


জীবনস্রোত আকাশে ঢালি


হৃদয়তলে বহ্নি জ্বালি চলেছি নিশিদিন।






বর্শা হাতে, ভর্‌সা প্রাণে,সদাই নিরুদ্দেশ,


মরুর ঝড় যেমন বহে সকল বাধাহীন।


বিপদ-মাঝে ঝাঁপায়ে প’ড়ে শোণিত উঠে ফুটে,


সকল দেহে সকল মনে জীবন জেগে উঠে—






অন্ধকারে সূর্যালোতে সন্তরিয়া মৃত্যুস্রোতে


নৃত্যময় চিত্ত হতে মত্ত হাসি টুটে।


বিশ্বমাঝে মহান যাহা সঙ্গী পরানের,


ঝঞ্ঝামাঝে ধায় সে প্রাণ সিন্ধুমাঝে লুটে।






নিমেষতরে ইচ্ছা করে বিকট উল্লাসে


সকল টুটে যাইতে ছুটে জীবন-উচ্ছ্বাসে—


শূন্য ব্যোম অপরিমাণ মদ্যসম করিতে পান


মুক্ত করি রুদ্ধ প্রাণ ঊর্ধ্ব নীলাকাশে।


থাকিতে নারি ক্ষুদ্র কোণে


আম্রবনছায়ে সুপ্ত হয়ে লুপ্ত হয়ে গুপ্ত গৃহবাসে।






বেহালাখানা বাঁকায়ে ধরি বাজাও ওকি সুর—


তবলা-বাঁয়া কোলেতে টেনে বাদ্যে ভরপুর!


কাগজ নেড়ে উচ্চস্বরে পোলিটিকাল তর্ক করে,


জানলা দিয়ে পশিছে ঘরে বাতাস ঝুরুঝুর।


পানের বাটা, ফুলের মালা, তবলা-বাঁয়া দুটো,


দম্ভ-ভরা কাগজগুলো করিয়া দাও দূর।






কিসের এত অহংকার! দম্ভ নাহি সাজে—


বরং থাকো মৌন হয়ে সসংকোচ লাজে।


অত্যাচারে মত্ত-পারা কভু কি হও আত্মহারা?


তপ্ত হয়ে রক্তধারা ফুটে কি দেহমাঝে?


অহর্নিশি হেলার হাসি তীব্র অপমান


মর্মতল বিদ্ধ করি বজ্রসম বাজে?






দাস্যসুখে হাস্যমুখ, বিনীত জোড়-কর,


প্রভুর পদে সোহাগ-মদে দোদুল কলেবর!


পাদুকাতলে পড়িয়া লুটি ঘৃণায় মাখা অন্ন খুঁটি


ব্যগ্র হয়ে ভরিয়া মুঠি যেতেছ ফিরি ঘর।


ঘরেতে ব’সে গর্ব কর পূর্বপুরুষের,


আর্যতেজদর্পভরে পৃথ্বী থরথর।






হেলায়ে মাথা, দাঁতের আগে মিষ্ট হাসি টানি


বলিতে আমি পারিব না তো ভদ্রতার বাণী।


উচ্ছ্বসিত রক্ত আসি বক্ষতল ফেলিছে গ্রাসি,


প্রকাশহীন চিন্তারাশি করিছে হানাহানি।


কোথাও যদি ছুটিতে পাই বাঁচিয়া যাই তবে—


ভব্যতার গণ্ডিমাঝে শান্তি নাহি মানি।






বর্ষার দিনে


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর






এমনও দিনে তারে বলা যায়


এমনও ঘন-ঘোর বরিষায়


এমনও দিনে মন খোলা যায়।


এমনও মেঘস্বরে বাদল ঝরঝরে


তপনও হীন ঘন তমসায়


এমনও দিনে তারে বলা যায়।


সে কথা শুনিবেনা কেহ আর


নিভৃত নির্জন চারিধার।


দু'জনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী


আকাশে জল ঝরে অনিবার।


জগতে কেহ যেন নাহি আর,


সমাজ সংসার মিছে সব


মিছে এ জীবনের কলরব।


কেবলই আঁখি দিয়ে আখিঁরও সুধা পিয়ে,


হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব


আঁধারে মিশে গেছে আর সব।


তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার


নামাতে পারি যদি মনোভার,


শ্রাবণ বরিষণে একদা গৃহকোণে


দু'কথা বলি যদি কাছে তার


তাহাতে আসে যাবে কিবা কার!


ব্যকুল বেগে আজি বহে বায়


বিজুলী থেকে থেকে চমকায়,


যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে


সে কথা আজি যেন বলা যায়।


এমনও ঘন-ঘোর বরিষায়


এমনও দিনে তারে বলা যায়।






বিপদে মোরে রক্ষা করো


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর






বিপদে মোরে রক্ষা করো


এ নহে মোর প্রার্থনা,


বিপদে আমি না যেন করি ভয়।


দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে


নাই বা দিলে সান্ত্বনা,


দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।


সহায় মোর না যদি জুটে


নিজের বল না যেন টুটে,


সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি


লভিলে শুধু বঞ্চনা


নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়।


আমারে তুমি করিবে ত্রাণ


এ নহে মোর প্রার্থনা,


তরিতে পারি শকতি যেন রয়।


আমার ভার লাঘব করি


নাই বা দিলে সান্ত্বনা,


বহিতে পারি এমনি যেন হয়।


নম্রশিরে সুখের দিনে


তোমারি মুখ লইব চিনে,


দুখের রাতে নিখিল ধরা


যেদিন করে বঞ্চনা


তোমারে যেন না করি সংশয়।






আষাঢ়


- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর






নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।


ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।।






বাদলের ধারা ঝরে ঝরো-ঝরো,


আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,


কালিমাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ্‌ চাহি রে।।






ঐ শোনো শোনো পারে যাবে ব’লে কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে।


খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।






পুবে হাওয়া বয়, কূলে নেই কেউ


দু-কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ


দরো-দরো বেগে জলে পড়ি জল ছলো-ছল উঠে বাজি রে।


খেয়া-পারাপার বন্ধ হয়েছে আজি রে।।






ঐ ডাকে শোনো ধেনু ঘন ঘন,


ধবলীরে আনো গোহালে


এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।






দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্‌ দেখি,


মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি


রাখালবালক কী জানি কোথায় সারা দিন আজি খোয়ালে।


এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।।






ওগো, আজ তোরা যাস নে গো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।


আকাশ আঁধার, বেলা বেশি আর নাহি রে।






ঝরো-ঝরো ধারে ভিজিবে নিচোল


ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল


ওই বেণুবন দোলে ঘন ঘন পথপাশে দেখ্‌ চাহি রে।।






সোনার তরী


-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর






গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।


কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।


রাশি রাশি ভারা ভারা


ধান কাটা হল সারা,


ভরা নদী ক্ষুরধারা


খরপরশা।


কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।






একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা,


চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।


পরপারে দেখি আঁকা


তরুছায়ামসীমাখা


গ্রামখানি মেঘে ঢাকা


প্রভাতবেলা—


এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।






গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,


দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।


ভরা-পালে চলে যায়,


কোনো দিকে নাহি চায়,


ঢেউগুলি নিরুপায়


ভাঙে দু-ধারে—


দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।


ওগো, তুমি কোথা যাও কোন্‌ বিদেশে,


বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।


যেয়ো যেথা যেতে চাও,


যারে খুশি তারে দাও,


শুধু তুমি নিয়ে যাও


ক্ষণিক হেসে


আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।


যত চাও তত লও তরণী-’পরে।


আর আছে?— আর নাই, দিয়েছি ভরে।


এতকাল নদীকূলে


যাহা লয়ে ছিনু ভুলে


সকলি দিলাম তুলে


থরে বিথরে—


এখন আমারে লহ করুণা করে।


ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই— ছোটো সে তরী


আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।


শ্রাবণগগন ঘিরে


ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,


শূন্য নদীর তীরে


রহিনু পড়ি—


যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।










আমার সোনার বাংলা


-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর






আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।


চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি ॥


ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,


মরি হায়, হায় রে--


ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥


কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো--


কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।


মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো,


মরি হায়, হায় রে--


মা, তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়নজলে ভাসি ॥


তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,


তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।


তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,


মরি হায়, হায় রে--


তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি ॥


ধেনু-চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়াঘাটে,


সারা দিন পাখি-ডাকা ছায়ায়-ঢাকা তোমার পল্লীবাটে,


তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিন কাটে,


মরি হায়, হায় রে--


ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল তোমার চাষি ॥


ও মা, তোর চরণেতে দিলেম এই মাথা পেতে--


দে গো তোর পায়ের ধূলা, সে যে আমার মাথার মানিক হবে।


ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,


মরি হায়, হায় রে--


আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব'লে গলার ফাঁসি ॥






পাছে লোকে কিছু বলে


-কামিনী রায়






করিতে পারি না কাজ, সদা ভয়, সদা লাজ,


সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,


পাছে লোকে কিছু বলে।


আড়ালে আড়ালে থাকি, নীরবে আপনা ঢাকি


সম্মুখ চরণ নাহি চলে,


পাছে লোকে কিছু বলে।


হৃদয়ে বুদবুদ-মত উঠে শুভ্র চিন্তা কত


মিশে যায় হৃদয়ের তলে,


পাছে লোকে কিছু বলে।


কাঁদে প্রাণ যবে, আঁখি সযতনে শুষ্ক রাখি


নির্মল নয়নের জলে,


পাছে লোকে কিছু বলে।


মহৎ উদ্দেশ্যে যবে একসাথে মিলে সবে,


পারিনা মিলিতে সেই দলে,


বিধাতা দিয়েছেন প্রাণ, থাকি সদা ম্রিয়মান,


শক্তি মরে ভীতির কবলে,


পাছে লোকে কিছু বলে।






সকলের তরে সকলে আমরা


- কামিনী রায়






"পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি


এ জীবন মন সকলি দাও,


তার মত সুখ কোথাও কি আছে?


আপনার কথা ভুলিয়া যাও।


পরের কারণে মরণেও সুখ,


‘সুখ-সুখ’ করি কেঁদো না আর;


যতই কাঁদিবে যতই ভাবিবে,


ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।


আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে


আসে নাই কেহ অবনী পরে


সকলের তরে সকলে আমরা


প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।"






কাজ


- আখতার হুসেন






মা ও বলেন , বাবাও বলেন


অভিযোগের সুরে


আমি নাকি আলসে এবং কুড়ে।


ঘরের কোনো কাজ করি না মিনু যেমন করে


সারাটা দিন ধরে।


তাইতো মিনু সবার কাছে লক্ষ্মী সোনা মেয়ে


বায়না যখন যা ধরে তাই তখ্খুনি যায় পেয়ে।


মিনুর কী কাজ ? কখনো বা মসলা পাতি বাটে


মা’র হয়ে বাসন-থালা যায় যে নিয়ে ঘাটে।


কলসি ভরে জল আনে আর


কাঁথায় নক্সা বোনে


কখনো বা ঝাড় দিয়ে যায়


দাওয়ায় , ঘরের কোণে।


আর আমি ? কাজ করি যে কতো সারাটা দিন ধরে


সে সব কথা একবারও কেউ , কেউ বলে না ঘরে।


কালবোশেখীর ঝড়


ভাঙলে পরে গাছের ডানা , পাখির বাসা-ঘর


আমি যে যাই ছুটে


খড়-কুটো সব খুঁজি গিয়ে মাঠপারে , প্রান্তরে


ওদের বাসা দেই বানিয়ে সযত্নে তারপরে।


এগুলো নয় কাজ ?


মা-বাবাকে বলবো গিয়ে আজ।


কাকলীদের খুড়ো


বড্ডো যে থুত্থুরো


শ্বাস নেন খুব ঘন ঘন পথ চলতে গেলে


থমকে দাঁড়ান চৌ-মাথাটার সাঁকোর ধারে এলে।


তখন ছুটে কেউ তো আসে নাকো


আমিই ছুটি আমিই তাঁকে পার করিয়ে


দেই যে বাঁশের সাঁকো।


এগুলো নয় কাজ ?


মা-বাবাকে বলবো গিয়ে আজ।


আকাশ-ভাঙা ঝমঝমানো ভর বর্ষা শেষে


দূর-বিদেশের রং বে-রঙের পাখিরা সব এসে-


শালুক বিলে বসায় যখন মেলা


মনের সুখে গান গায় আর কেবল খেলে খেলা ;


শুনতে পেয়ে তাদের সে গান , হরেক রকম ডাক


ছুটে আসে শালুক বিলে শিকারীদের ঝাঁক-


তখন আমি ঢিলের পরে ঢিলটা ওদের ছুঁড়ে


শিকারীদের নাগাল থেকে দেই পাঠিয়ে দূরে।


এগুলো নয় কাজ ?


মা-বাবাকে বলবো গিয়ে আজ।






আমাদের গ্রাম


– বন্দে আলী মিয়া






আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,


থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর৷


পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,


এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই৷


আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,


আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইয়াছে প্রাণ৷


মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘি,


চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি৷


আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন,


মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন৷


সকালে সোনার রবি পুব দিকে ওঠে,


পাখি ডাকে, বায়ু বয়, নানা ফুল ফোটে৷






অধম ও উত্তম


– সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত






কুকুর আসিয়া এমন কামড়


দিল পথিকের পায়


কামড়ের চোটে বিষদাঁত ফুটে


বিষ লেগে গেল তায়।


ঘরে ফিরে এসে রাত্রে বেচারা


বিষম ব্যথায় জাগে,


মেয়েটি তাহার তারি সাথে হায়


জাগে শিয়রের আগে।


বাপেরে সে বলে ভর্ৎসনা-ছলে


কপালে রাখিয়া হাত,


“তুমি কেন বাবা, ছেড়ে দিলে তারে


তোমার কি নেই দাঁত !”


কষ্টে হাসিয়া আর্ত কহিল


“তুই রে হাসালি মোরে,


দাঁত আছে বলে কুকুরের পায়


দংশি কেমন করে !


কুকুরের কাজ কুকুর করেছে


কামড় দিয়েছে পায়,


তা ব’লে কুকুরে কামড়ানো কি রে


মানুষের শোভা পায় ?”






দূরের পাল্লা


-সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত






ছিপখান তিন-দাঁড় তিনজন মাল্লা


চৌপর দিন-ভর দেয় দৌঁড়-পাল্লা


পাড়ময় ঝোপঝাড় জংগল, জঞ্জাল...


জলময় শৈবাল পান্নার টাঁকশাল!...


কঞ্চির তীর-ঘর ঐ-চর জাগছে..


বন-হাঁস ডিম তার শ্যাওলায় ঢাকছে..


চুপ চুপ- ওই ডুব দ্যায় পান্ কৌটি..


দ্যায় ডুব টুপ টুপ ঘোমটার বৌটি!..


পান সুপারি ! পান সুপারি !


এইখানেতে শঙ্কা ভারি


পাঁচ পীরনী শীর্ণি মেনে


চলরে টেনে বৈঠা হেনে






পারিব না


- কালীপ্রসন্ন ঘোষ






'পারিব না' একথাটি বলিও না আর,


কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার;


পাঁচজনে পারে যাহা,


তুমিও পারিবে তাহা,


পার কি না পার কর যতন আবার


একবার না পারিলে দেখ শতবার।


পারিবে না বলে মুখ করিও না ভার,


ও কথাটি মুখে যেন না শুনি তোমার।


অলস অবোধ যারা


কিছুই পারে না তারা,


তোমায় তো দেখি নাক তাদের আকার


তবে কেন 'পারিব না' বল বার বার ?


জলে না নামিলে কেহ শিখে না সাঁতার,


হাঁটিতে শিখে না কেহ না খেয়ে আছাড়,


সাঁতার শিখিতে হলে


আগে তবে নাম জলে,


আছাড়ে করিয়া হেলা 'হাঁট' আর বার;


পারিব বলিয়া সুখে হও আগুসার।






প্রার্থনা


-সুফিয়া কামাল






তুলি দুই হাত করি মোনাজাত


হে রহিম রহমান


কত সুন্দর করিয়া ধরণী


মোদের করেছ দান,






গাছে ফুল ফল


নদী ভরা জল


পাখির কন্ঠে গান


সকলি তোমার দান ৷






মাতা, পিতা, ভাই, বোন ও স্বজন


সব মানুষেরা সবাই আপন


কত মমতায় মধুর করিয়া


ভরিয়া দিয়াছ প্রাণ ৷






তাই যেন মোরা তোমারে না ভুলি


সরল সহজ সত্‍ পথে চলি


কত ভাল তুমি, কত ভালবাস


গেয়ে যাই এই গান ৷










অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি


-গোলাম মোস্তফা






অনন্ত অসীম প্রেমময় তুমি


বিচার দিনের স্বামী।


যত গুনগান হে চির মহান,


তোমারি অন্তর্যামী।।






দ্যুলোকে ভুলোকে সবারে ছাড়িয়া


তোমারি কাছে পড়ি লুটাইয়া


তমারি কাছে যাচি হে শকতি,


তোমারি করুনা কামি।।






সরল সঠিক পুন্য পন্থা


মোদেরে দাওগো বলি'


চালাও সে পথে


যে পথে তোমার


প্রিয়জন গেছে চলি।






যে পথে তোমার চির অভিশাপ


যে পথে ভ্রান্তি চির পরিতাপ


গে মহাচালক, মোদেরে কখনো


করো না সে পথগামী।।






পন্ডশ্রম


-শামসুর রাহমান






এই নিয়েছে ঐ নিয়েছে যা ! কান নিয়েছে চিলে,


চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে ।


দিন দুপুরে জ্যান্ত আহা ,কানটা গেল উড়ে,


কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুড়ে।


যাচ্ছে ,গেল সবই গেল ,জাত মেরছে চিলে,


পাজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি -জুতো-কিলে।


মিটিং হল ফিটিং হল ,কান মেলে না তবু,


ডানে -বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভূ।


ছুটতে দেখে ছোট খোকা বলল,কেন মিছে


কানের খোঁজে মরছ কেন ঘূরে সোনার চিলের পিছে?


নেই খালে ,নেই বিলে,নেই মাঠে গাছে;


কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।


ঠিক বলেছে ,চিল তবে কি নয়কো কানের যম ?


বৃথাই মাথার ঘাম ফেলছি,পন্ড হল শ্রম।






ষোলা আনাই মিছে


-সুকুমার রায়






বিদ্যেবোঝাই বাবুমশাই চড়ি সখের বোটে,


মাঝিরে কন, ''বলতে পারিস সূর্যি কেন ওঠে?


চাঁদটা কেন বাড়ে কমে? জোয়ার কেন আসে?''


অবাক হয়ে ফ্যাল্‌ফেলিয়ে হাসে।


বাবু বলেন, ''সারা জীবন মরলিরে তুই খাটি,


জ্ঞান বিনা তোর জীবনটা যে চারি আনাই মাটি।''


খানিক বাদে কহেন বাবু, ''বলতো দেখি ভেবে


নদীর ধারা কেমনে আসে পাহাড় থেকে নেবে?


বলতো কেন লবণপোরা সাগর ভরা পানি?''


মাঝি সে কয়, ''আরে মশাই অত কি আর জানি?''


বাবু বলেন, ''এই বয়সে জানিসনেও তা কি


জীবনটা তোর নেহাৎ খেলো, অষ্ট আনাই ফাঁকি!''


আবার ভেবে কহেন বাবু, '' বলতো ওরে বুড়ো,


কেন এমন নীল দেখা যায় আকাশের ঐ চুড়ো?


বলতো দেখি সূর্য চাঁদে গ্রহণ লাগে কেন?''


বৃদ্ধ বলে, ''আমায় কেন লজ্জা দেছেন হেন?''


বাবু বলেন, ''বলব কি আর বলব তোরে কি তা,-


দেখছি এখন জীবনটা তোর বারো আনাই বৃথা।''


খানিক বাদে ঝড় উঠেছে, ঢেউ উঠেছে ফুলে,


বাবু দেখেন, নৌকাখানি ডুবলো বুঝি দুলে!


মাঝিরে কন, '' একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,


ডুবলো নাকি নৌকা এবার? মরব নাকি আজি?''


মাঝি শুধায়, ''সাঁতার জানো?''- মাথা নাড়েন বাবু


মূর্খ মাঝি বলে, ''মশাই, এখন কেন কাবু?


বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,


তোমার দেখি জীবন খানা ষোল আনাই মিছে!''






বাবুরাম সাপুড়ে


-সুকুমার রায়






বাবুরাম সাপুড়ে,


কোথা যাস বাপুরে


আয় বাবা দেখে যা, দুটো সাপ রেখে যা -


যে সাপের চোখ নেই,


শিং নেই, নোখ নেই,


ছোটে না কি হাঁটে না,


কাউকে যে কাটে না,


করে না কো ফোঁসফাঁস


মারে নাকো ঢুসঢাস,


নেই কোন উৎপাত,


খায় শুধু দুধভাত,


সেই সাপ জ্যান্ত,


গোটা দুই আন তো,


তেড়ে মেরে ডাণ্ডা


ক'রে দিই ঠাণ্ডা।










কানা বগীর ছা


-খান মুহাম্মদ মইনুদ্দীন






ঐ দেখা যায় তাল গাছ


ঐ আমাদের গাঁ।


ঐ খানেতে বাস করে


কানা বগীর ছা।


ও বগী তুই খাস কি?


পানতা ভাত চাস কি?


পানতা আমি খাই না


পুঁটি মাছ পাই না


একটা যদি পাই


অমনি ধরে গাপুস গুপুস খাই।






শিক্ষাগুরুর মর্যাদা


-কাজী কাদের নেওয়াজ






বাদশাহ আলমগীর-


কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।


একদা প্রভাতে গিয়া


দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া


ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে


পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,


শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি


ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।


শিক্ষক মৌলভী


ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।


দিল্লীপতির পুত্রের করে


লইয়াছে পানি চরণের পরে,


স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!


ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।


হঠাৎ কি ভাবি উঠি


কহিলেন, আমি ভয় করি না'ক, যায় যাবে শির টুটি,


শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার


দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,


ভয় করি না'ক, ধারি না'ক ধার, মনে আছে মোর বল,


বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।


যায় যাবে প্রাণ তাহে,


প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।


তার পরদিন প্রাতে


বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।


খাস কামরাতে যবে


শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ''শুনুন জনাব তবে,


পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?


বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,


নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা''


শিক্ষক কন-''জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,


কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?''


বাদশাহ্ কহেন, ''সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে


নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,


পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।


নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে


ধুয়ে দিল না'ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।''


উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে


কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-


''আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,


সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।''






সফদার ডাক্তার


- হোসনে আরা






সফদার ডাক্তার মাথাভরা টাক তার


খিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ে,


চেয়ারেতে রাতদিন বসে গোণে দুই-তিন


পড়ে বই আলোটারে নিভিয়ে।


ইয়া বড় গোঁফ তার, নাই যার জুড়িদার


শুলে তার ভুঁড়ি ঠেকে আকাশে,


নুন দিয়ে খায় পান, সারাক্ষণ গায় গান


বুদ্ধিতে অতি বড় পাকা সে।


রোগী এলে ঘরে তার, খুশিতে সে চারবার


কষে দেয় ডন আর কুস্তি,


তারপর রোগীটারে গোটা দুই চাঁটি মারে


যেন তার সাথে কত দুস্তি।


ম্যালেরিয় হলে কারো নাহি আর নিস্তার


ধরে তারে কেঁচো দেয় গিলিয়ে,


আমাশয় হলে পরে দুই হাতে কান ধরে


পেটটারে ঠিক করে কিলিয়ে।


কলেরার রোগী এলে, দুপুরের রোদে ফেলে


দেয় তারে কুইনিন খাইয়ে,


তারপর দুই টিন পচা জলে তারপিন


ঢেলে তারে দেয় শুধু নাইয়ে।


ডাক্তার সফদার, নাম ডাক খুব তার


নামে গাঁও থরথরি কম্প,


নাম শুনে রোগী সব করে জোর কলরব


পিঠটান দিয়ে দেয় লম্ফ।


একদিন সককালে ঘটল কি জঞ্জাল


ডাক্তার ধরে এসে পুলিশে,


হাত-কড়া দিয়ে হাতে নিয়ে যায় থানাতে


তারিখটা আষাঢ়ের উনিশে।






মজার দেশ


-যোগীন্দ্রনাথ সরকার






এক যে আছে মজার দেশ,


সব রকমে ভালো ,


রাত্তিরেতে বেজায় রোদ ,


দিনে চাঁদের আলো ।


আকাশ সেথা সবুজ বরন


গাছের পাতা নীল ,


ডাঙায় চরে রুই কাতলা


জলের মাঝে চিল !


সেই দেশেতে বেড়াল পালায় ,


নেংটি-ইঁদুর দেখে ;


ছেলেরা খায় ক্যাস্টর-অয়েল-


রসগোল্লা রেখে !


মন্ডা-মিঠাই তেতো সেথা ,


ওষুধ লাগে ভালো ;


অন্ধকারটা সাদা দেখায় ,


সাদা জিনিষ কালো !


ছেলেরা সব খেলা ফেলে


বই নিয়ে বসে পড়ে ;


মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া


লোকের পিঠে চড়ে ;


ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই ,


উড়তে থাকে ছেলে ;


বরশি দিয়ে মানুষ গাঁথে ,


মাছেরা ছিপ ফেলে ;


জিলিপি সে তেরে আসে ,


কামড়ে দিতে চায় !


কচুরি আর রসগোল্লা


ছেলে ধরে খায় !


পায়ে ছাতা দিয়ে লোকে


হাতে হেঁটে চলে !


ডাঙায় ভাসে নৌকা জাহাজ ,


গাড়ি ছোটে জলে !


মজার দেশের মজার কথা


বলবো কত আর ;


চোখ খুললে যায় না দেখা


মুদলে পরিষ্কার ।


http://www.alkama.org/Classicpoems/






চাচায় চা চায় চাচী চ্যাঁচায়


- নকুল কুমার বিশ্বাস






চাচায় চা চায়


চাচী চ্যাঁচায়






চা চড়াতে চায় না চাচী চচ্চড়ি চুলায়।


চাচার চিকন চাকন চেহারাটা চান্দিটা চচকচে


চরণের চামড়ার চটি, চীনা চশমা চোখে


চাচা চিরকালই চালাক চতুর চাটুকারিতায়।।






চাচায় চায়রে চা চানাচুর চাচী চিড়া-চাল


চাচা-চাচীর চেঁচাচেচি চলছে চিরকাল


চাছা চটা চেছে চাচা চাচীরে চটায়।।


চাচী চাচার চাল চলনে চটে চড়া চোখে চায়






চাচীর চোখের চাহনিতে চাচা চমকায়


চাচার চেয়ে চাঈ চালু চিন্তা-চেতনায়।






চাচায় চা চায়


চাচী চ্যাঁচায়


চাচীর চাবিতে চলে চাটুকার চাচায়।।


-http://www.ebanglalyrics.com/3466#sthash.fdYtfwZv.dpuf










কুঠির


- অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত






ঝিকিমিকি দেখা যায় সোনালী নদীর,


ওইখানে আমাদের পাতার কুঠির ।


এলোমেলো হাওয়া বয়,


সারাবেলা কথা কয়,


কুঠিরের কোল ঘেঁষে একটু উঠোন,


নেচে নেচে খেলা করি ছোট দুটি বোন ।


আকাশে গড়িয়া উঠে মেঘের মিনার,


তারি ফাঁকে দেখা যায় চাঁদের কিনার ।


গাছের পাতার ফাঁকে,


আকাশ যে চেয়ে থাকে,


গুনগুন গাই গান, চোখে নাই ঘুম,


চাঁদ যেন আমাদের নিকট কুটুম ।


নৌকারা আসে যায় পাটেতে বোঝাই,


দেখে কি যে খুশি লাগে কি করে বোঝাই,


কত দুর দেশ থেকে,


আসিয়াছে এঁকে বেঁকে,


বাদলে 'বদর' বলে তুলিয়া বাদাম,


হাল দিয়ে ধরে রাখে মেঘের লাগাম ।


দু'কদম হেঁটে এসে মোদের কুঠির,


পিলসুজে বাতি জ্বলে মিটির মিটির ।


চাল আছে ঢেঁকিছাঁটা,


রয়েছে পানের বাটা,


কলাপাতা ভরে দেব ঘরে পাতা দই,


এই দেখ আছে মোর আয়না কাঁকই ।


যদি আস একবার, বলি- মিছা না,


মোদের উঠোনটুকু ঠিক বিছানা ।


পিয়াল, পেয়ারা গাছে,


ছায়া করে রহিয়াছে,


ধুঁধুলের ঝাঁকা বেয়ে উঠেতেছে পুঁই,


খড়কুটো খুঁজে ফেরে দুষ্টু চড়ুই ।


আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে!






আদর্শ ছেলে


-কুসুমকুমারী দাশ






আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে


কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে ?


মুখে হাসি বুকে বল, তেজে ভরা মন


‘মানুষ হইতে হবে’ – এই যার পণ।


বিপদ আসিলে কাছে হও আগুয়ান


নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ ?


হাত পা সবারই আছে, মিছে কেন ভয় ?


চেতনা রয়েছে যার, সে কি পড়ে রয় ?


সে ছেলে কে চায় বল, কথায় কথায়


আসে যার চোখেজল, মাথা ঘুরে যায় ?


মনে প্রাণে খাট সবে, শক্তি কর দান,


তোমরা ‘মানুষ’ হলে দেশের কল্যাণ।










সবার আমি ছাত্র


-সুনির্মল বসু






আকাশ আমায় শিক্ষা দিল


উদার হতে ভাই রে,


কর্মী হবার মন্ত্র আমি


বায়ুর কাছে পাই রে।


পাহাড় শিখায় তাহার সমান-


হই যেন ভাই মৌন-মহান,


খোলা মাঠের উপদেশে-


দিল-খোলা হই তাই রে।


সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়


আপন তেজে জ্বলতে,


চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,


মধুর কথা বলতে।


ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর-


অন্তর হোক রত্ন-আকর;


নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম


আপন বেগে চলতে।


মাটির কাছে সহিষ্ণুতা


পেলাম আমি শিক্ষা,


আপন কাজে কঠোর হতে


পাষান দিল দীক্ষা।


ঝরনা তাহার সহজ গানে,


গান জাগাল আমার প্রাণে;


শ্যাম বনানী সরসতা


আমায় দিল ভিক্ষা।


বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,


সবার আমি ছাত্র,


নানান ভাবে নতুন জিনিস


শিখছি দিবারাত্র।


এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,


পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়


শিখছি সে সব কৌতূহলে,


নেই দ্বিধা লেশমাত্র।






পাঞ্জেরি


- ফররুখ আহমেদ






রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?


এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?


সেতারা, হেলার এখনো ওঠেনি জেগে?


তুমি মাস্তলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;


অসীম কুয়াশা জাগে শূন্যতা ঘেরি।


রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?


দীঘল রাতের শ্রান্তসফর শেষে


কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?


এ কী ঘন-সিয়া জিন্দেগানীর বা’ব


তোলে মর্সিয়া ব্যথিত দিলের তুফান-শ্রান্ত খা’ব


অস্ফুট হয়ে ক্রমে ডুবে যায় জীবনের জয়ভেরী।


তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;


সম্মুখে শুধু অসীম কুয়াশা হেরি।


রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?


বন্দরে বসে যাত্রীরা দিন গোনে,


বুঝি মৌসুমী হাওয়ায় মোদের জাহাজের ধ্বনি শোনে,


বুঝি কুয়াশায়, জোছনা- মায়ায় জাহাজের পাল দেখে।


আহা, পেরেশান মুসাফির দল।


দরিয়া কিনারে জাগে তক্দিরে


নিরাশায় ছবি এঁকে!


পথহারা এই দরিয়া- সোঁতারা ঘুরে


চলেছি কোথায়? কোন সীমাহীন দূরে?


তুমি মাস্তুলে, আমি দাঁড় টানি ভুলে;


একাকী রাতের গান জুলমাত হেরি!


রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরি?


শুধু গাফলতে শুধু খেয়ালের ভুলে,


দরিয়া- অথই ভ্রান্তি- নিয়াছি ভুলে,


আমাদেরি ভুলে পানির কিনারে মুসাফির দল বসি


দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের সেতারা, শশী।


মোদের খেলায় ধুলায় লুটায়ে পড়ি।


কেটেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্বরী।


সওদাগরের দল মাঝে মোরা ওঠায়েছি আহাজারি,


ঘরে ঘরে ওঠে ক্রন্দনধ্বনি আওয়াজ শুনছি তারি।


ওকি বাতাসের হাহাকার,- ও কি


রোনাজারি ক্ষুধিতের!


ও কি দরিয়ার গর্জন,- ও কি বেদনা মজলুমের!


ও কি ধাতুর পাঁজরায় বাজে মৃত্যুর জয়ভেরী।


পাঞ্জেরি!


জাগো বন্দরে কৈফিয়তের তীব্র ভ্রুকুটি হেরি,


জাগো অগণন ক্ষুধিত মুখের নীরব ভ্রুকুটি হেরি!


দেখ চেয়ে দেখ সূর্য ওঠার কত দেরি, কত দেরি!!






আজান


- কায়কোবাদ






কে অই শুনালো মোরে


আজানের ধ্বনি!


মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সমুধুর


আকুল হইল প্রাণ বাজিল ধমনী!


কি মধুর


আজানের ধ্বনি!






আমি তো পাগল হয়ে


সে মধুর তানে


কি যে এক আকর্ষণে ছুটে যাই মুগ্ধ মনে


কি নিশীথে কি দিবসে


মসজিদের পানে।


হৃদয়ের তারে তারে, প্রাণের শোণিত ধারে


কি যে এক ঢেউ উঠে


ভক্তির তুফানে


কত সুধা আছে সেই মধুর আজানে!






নদী ও পাখীর তানে


তারি প্রতিধ্বনি!


ভ্রমরের গুণগানে, সেই সুর আসে কানে


কি এক আবেশে মুগ্ধ


নিখিল ধরনী!


ভূধরে সাগরে জলে নির্ঝরিণী কল কলে


আমি যেন শুনি সেই আজানের ধ্বনি।






যবে সেই সুর


ভাসে দূরে সায়াহ্নের নিথর অম্বরে!


প্রাণ করে আনচার, কি মধুর সে আজান,


তারি প্রতিধ্বনি শুনি আত্মার ভিতরে!






আকাশের পানে আমি


চেয়ে থাকি যবে,


চন্দ্র সূর্য্য তারকায় অই সুর শুনি হায়


সবাই গাহিয়া যায়


নীরবে নীরবে!


ফুলের সৌরভ নিয়া, পাতাগুলি দোলাইয়া


নৈশ বায়ু বহে যবে


‘শর শর’ রবে!


তাহারি প্রত্যেক শ্বাসে, সেই সুর ভেসে আসে


ভ্রমান্ধ মানব তাহা বোঝে না এ ভবে!






ঊষা যবে ফুল সাজে


আসে ধরাধামে!


বিশ্বপতি পূজা তরে শেফালী ঝরিয়া পড়ে


রজনী প্রণমে তারে


প্রতি যামে যামে!


নীরব নিঝুম ধরা, বিশ্বে যেন সবি মরা


একটুকু শব্দ যবে


নাহিক কোন স্থানে!


মোয়াজ্জিন উচ্চৈস্বরে, দাঁড়ায়ে মিনার প’রে


কি সুধা ছড়িয়ে দেয়


ঊষার আজানে।


জাগাইতে মোহ মুগ্ধ মানব-সন্তানে।


লা-ইলাহা ইললাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুল্লাহ,


মুয়াযযিন মিনারে উঠি ফুকারে যখন,


সবাই ভক্তি ভরে


তাঁহারই অর্চনা করে


এ সৌরজগৎ যিনি করেছেন সৃজন।


আহা, কি মধুর ওই আযানের ধ্বনি।


মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর


আকুল হইল প্রাণ, নাচিল ধমনী।










কাজলা দিদি


-যতীন্দ্র মোহন বাগচী






বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,


মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?


পুকুর ধারে লেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাক জ্বলে


ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-


মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?


সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;-


দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?


খাবার খেতে আসি যখন, দিদি বলে ডাকি তখন,


ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?


আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?


বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?


কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!


দিদির মত ফাঁকি দিয়ে, আমিও যদি লুকাই গিয়ে


তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,


আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।


ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,


মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।


ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,


উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-


দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!


বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-


এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?


লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে'


ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই


রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?






মেঘনায় ঢল


- হুমায়ুন কবির






শোন্ মা আমিনা, রেখে দে রে কাজ


ত্বরা করে মাঠে চল,


এল মেঘনায় জোয়ারের বেলা এখনি নামিবে ঢল।


নদীর কিনার ঘন ঘাসে ভরা


মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা


করিস না দেরি--আসিয়া পড়িবে সহসা অথই জল


মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা মেঘনায় নামে ঢল।


এখনো যে মেয়ে আসে নাই ফিরে--দুপুর যে বয়ে যায়।


ভরা জোয়ারের মেঘনার জল কূলে কূলে উছলায়।


নদীর কিনার জলে একাকার,


যেদিকে তাকাই অথই পাথার,


দেখতো গোহালে গরুগুলি রেখে গিয়েছে কি ও


পাড়ায় ?


এখনো ফিরিয়া আসে নাই সে কি ? দুপুর যে বয়ে যায়।


ভরবেলা গেলো, ভাটা পড়ে আসে, আঁধার জমিছে আসি,


এখনো তবুও এলো না ফিরিয়া আমিনা সর্বনাশী।


দেখ্ দেখ্ দূরে মাঝ-দরিয়ায়


কাল চুল যেন ঐ দেখা যায়--


কাহার শাড়ির আঁচল-আভাস সহসা উঠিছে ভাসি ?


আমিনারে মোর নিল কি টানিয়া মেঘনা সর্বনাশী ?






নন্দলাল


-দিজ্বেন্দ্রলাল রায়






নন্দলাল তো একদা একটা করিল


ভীষণ পণ-


স্বদেশের তরে যে করেই হোক


রাখিবেই সে জীবন


সকলে বলিল, “আহা হা, কর কী, কর


কী নন্দলাল? ”


নন্দ বলিল, “বসিয়া বসিয়া রহিব


কি চিরকাল?


আমি না করিলে কে করিবে আর


উদ্ধার এই দেশ”


তখন সকলে কহিল, “বাহবা,


বাহবা, বাহবা, বেশ।”


নন্দর ভাই কলেরায় মরে ,


দেখিবে তাহারে কে বা?


সকলে বলিল, “যাও না নন্দ ,


করনা ভায়ের সেবা।”


নন্দ বলিল, “ভায়ের জন্য


জীবনটা যদি দিই-


না হয় দিলাম, কিন্তু,


অভাগা দেশের হইবে কী?


বাঁচাটা আমার অতি দরকার,


ভেবে দেখ চারিদিক। ”


তখন সকলে বলিল, “হাঁ হাঁ হাঁ ,


তা বটে, তা বটে, ঠিক। ”


নন্দ একদা হঠাৎ একটা কাগজ


করিল বাহির-


গালি দিয়া সব গদ্যে-


পদ্যে বিদ্যা করিল জাহির।


পড়িল ধন্য , দেশের জন্য নন্দ


খাটিয়া খুন-


লেখে যত তার দ্বিগুণ ঘুমায়, খায়


তার দশগুণ।


খাইতে ধরিল লুচি আর ছোঁকা,


সন্দেশ থাল-থাল –


তখন সকলে কহিল, “বাহবা,


বাহবা, নন্দলাল।”


নন্দ বাড়ীর হত না বাহির ,


কোথা কী ঘটে কি জানি,


চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন


উল্টায় গাড়িখানি।


নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ,


রেলে কলিশন হয়,


হাঁটিলে সর্প, কুক্কুর আর


গাড়ি চাপা পড়া ভয়।


তাই


শুয়ে শুয়ে কষ্টে বাঁচিয়া রহিল


নন্দলাল-


সকলে বলিল, “ভ্যালা রে নন্দ,


বেঁচে থাক চির কাল”






ধনধান্য পুষ্প ভরা


-দিজ্বেন্দ্রলাল রায়






ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা


তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা


ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা


এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি


ও সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি


সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।।


চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা, কোথায় উজল এমন ধারা


কথাই এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে


তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি পাখির ডাকে জেগে ।।


এত স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধূম্র পাহাড়


কোথায় এমন হরিত ক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে


এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে ।।


পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী, কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি


গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে


তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।।


ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?


ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি


আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি।।






কাজের লোক


- নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য






মৌমাছি, মৌমাছি


কোথা যাও নাচি নাচি


দাঁড়াও না একবার ভাই।


ওই ফুল ফোটে বনে


যাই মধু আহরণে


দাঁড়াবার সময় তো নাই।


ছোট পাখি, ছোট পাখি


কিচিমিচি ডাকি ডাকি


কোথা যাও বলে যাও শুনি।


এখন না কব কথা


আনিয়াছি তৃণলতা


আপনার বাসা আগে বুনি।


পিপীলিকা, পিপীলিকা


দলবল ছাড়ি একা


কোথা যাও, যাও ভাই বলি।


শীতের সঞ্চয় চাই


খাদ্য খুঁজিতেছি তাই


ছয় পায়ে পিলপিল চলি।






আমার পণ


- মদনমোহন তর্কালঙ্কার






সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,


সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।


আদেশ করেন যাহা মোর গুরুজনে,


আমি যেন সেই কাজ করি ভালো মনে।


ভাইবোন সকলেরে যেন ভালোবাসি,


এক সাথে থাকি যেন সবে মিলেমিশি।


ভালো ছেলেদের সাথে মিশে করি খেলা,


পাঠের সময় যেন নাহি করি হেলা।


সুখী যেন নাহি হই আর কারো দুখে,


মিছে কথা কভু যেন নাহি আসে মুখে।


সাবধানে যেন লোভ সামলিয়ে থাকি,


কিছুতে কাহারে যেন নাহি দিঈ ফাঁকি।


ঝগড়া না করি যেন কভু কারো সনে,


সকালে উঠিয়া এই বলি মনে মনে।






পাখি-সব করে রব


- মদনমোহন তর্কালঙ্কার






পাখী-সব করে রব, রাতি পোহাইল।


কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল।।


রাখাল গরুর পাল, ল'য়ে যায় মাঠে।


শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।।


ফুটিল মালতী ফুল, সৌরভ ছুটিল।


পরিমল লোভে অলি, আসিয়া জুটিল।।


গগনে উঠিল রবি, লোহিত বরণ।


আলোক পাইয়া লোক, পুলকিত মন।।


শীতল বাতাস বয়, জুড়ায় শরীর।


পাতায় পাতায় পড়ে, নিশির শিশির।।


উঠ শিশু মুখ ধোও, পর নিজ বেশ।


আপন পাঠেতে মন, করহ নিবেশ।।






লেখাপড়া


-মদনমোহন তর্কালঙ্কার






লেখাপড়া করে যে


গাড়িঘোড়া চড়ে সে


লেখাপড়া যেই জানে


সবলোকে তারে মানে






স্বাধীনতার সুখ


-রজনীকান্ত সেন






বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই,


কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই,


আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকা পরে


তুমি কত কষ্ট পাও রোদ, বৃষ্টি, ঝড়ে।


বাবুই হাসিয়া কহে-সন্দেহ কি তায়?


কষ্ট পাই, তবু থাকি নিজের বাসায়,


পাকা হোক, তবু ভাই, পরের ও বাসা,


নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর খাসা।






ভালো থেকো


- হুমায়ূন আজাদ


ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।


ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো।


ভালো থেকো মেঘ, মিটিমিটি তারা।


ভালো থেকো পাখি সবুজ পাতারা।


ভালো থেকো


চর, ছোট কুড়ে ঘর, ভালো থেকো।


ভালো থেকো চিল, আকাশের নীল, ভালো থেকো।


ভালো থেকো পাতা, নিশির শিশির।


ভালো থেকো জল, নদীটির তীর।


ভালো থেকো গাছ, পুকুরের মাছ, ভালো থেকো।


ভালো থেকো কাক কুহুকের ডাক, ভালো থেকো।


ভালো থেকো মাঠ, রাখালের বাশিঁ।


ভালো থেকো লাউ, কুমড়োর হাসি।


ভালো থেকো আম, ছায়া ঢাকা গ্রাম, ভালো থেকো।


ভালো থেকো ঘাস, ভোরের বাতাস, ভালো থেকো।


ভালো থেকো রোদ, মাঘের কোকিল,


ভালো থেকো বক আড়িয়ল বিল,


ভালো থেকো নাও, মধুমতি গাও,ভালো থেকো।


ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলেবেলা, ভালো থেকো।


ভালো থেকো, ভালো থেকো, ভালো থেকো।






কেউ কথা রাখেনি


- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়






কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর


কাটলো কেউ কথা রাখেনি


ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমি তার


আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিলো


শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু


শুনিয়ে যাবে


তারপর কত চন্দ্রভুক


অমবস্যা এসে চলে গেল, কিন্তু সেই


বোষ্টুমি আর এলো না


পঁচিশ বছর প্রতীক্ষায় আছি ।


মামাবাড়ির মাঝি নাদের


আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর


তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল


দেখাতে নিয়ে যাবো


সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর


ভ্রমর খেলা করে !


নাদের আলি, আমি আর কত বড় হবো ? আমার


মাথা এই ঘরের ছাদ


ফুঁরে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর


তুমি আমায় তিন প্রহরের বিল দেখাবে ?


একটাও রয়্যাল


গুলি কিনতে পারিনি কখনো


লাঠি-লজেন্স


দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্কর বাড়ির


ছেলেরা


ভিখারীর মতন চৌধুরীদের


গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি ভেতরে রাস


উৎসব


অবিরল রঙ্গের ধারার মধ্যে সুবর্ণ


কঙ্কণ পড়া ফর্সা রমণীরা কতরকম


আমোদে হেসেছে


আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি !


বাবা আমার কাঁধ ছুঁয়ে বলেছিলেন,


দেখিস, একদিন আমরাও...


বাবা এখন অন্ধ, আমাদের


দেখা হয়নি কিছুই


সেই রয়্যাল গুলি, সেই লাঠি-লজেন্স,


সেই রাস উৎসব


আমায় কেউ ফিরিয়ে দেবে না !


বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল


রেখে বরুণা বলেছিল,


যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে


সেদিন আমার বুকেও এরকম আতরের গন্ধ


হবে !


ভালবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয়


প্রাণ নিয়েছি


দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়


বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন


করে খুঁজে এনেছি ১০৮ নীলপদ্ম


তবু কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার


বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ


এখনো সে যে কোন নারী !


কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো,


কেউ কথা রাখেনা !






আমি বলছিনা ভালবাসতেই হবে


-নির্মলেন্দু গুণ






আমি বলছিনা


ভালবাসতেই হবে


আমি চাই


কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক


শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরজা খুলে দেয়ার জন্য






বাইরে থেকে দরজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত


আমি বলছিনা


ভালবাসতেই হবে


আমি চাই


কেউ আমাকে খেতে দিক


আমি হাতপাখা নিয়ে আমার পাশে বসে থাকতে বলছিনা


আমি জানি এই ইলেকট্রিকের যুগ নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী সেবার দায় থেকে


আমি চাই কেউ একজন জিগ্যেস করুক


তোমার জল লাগবে কিনা


নুন লাগবে কিনা


পাট শাক ভাজার সাথে আরও একটা তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কিনা


এঁটো বাসন,গেঞ্জি রুমাল


আমি নিজেই ধুতে পারি


আমি বলছিনা


ভালবাসতেই হবে


আমি চাই কেউ একজন ভিতর থেকে দরজা খুলে দিক


কেউ আমাকে কিছু খেতে বলুক


কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক


কেউ অন্তত আমাকে জিগ্যেস করুক


তোমার চোখ


এতো লাল কেনো!








লাথি


দ্বিজেন্দ্রলাল রায়






আমি যদি পিঠে তোর ঐ


লাথি একটা মারিই রাগে;


তোর তো আস্পর্ধা বড়,


পিঠে যে তোর ব্যথা লাগে?


আমার পায়ে লাগলো সেটা


কিছুই বুঝি নয়কো বেটা?


নিজের জ্বালায় নিজে মরিস,


নিজের কথাই ভাবিস আগে।


লাথি যদি না খাবি ত’


জন্মেছিলি কিসের জন্যে?


আমি যদি না মারি তো,


মেরে সেটা যাবে অন্যে।


আমার লাথি খেয়ে কাঁদা,


ন্যাকামি নয়? শুয়োর গাধা!


দেখছি যে তোর পিঠের চামড়া


ভরে গেছে জুতোর দাগে!


আমার সেটা অনুগ্রহ


যদি লাথি মেরেই থাকি;


লাথি যদি না মারতাম তো


না মারতেও পারতাম না কি?


লাথি খেয়ে ওরে চাষা!


বরং রে তোর উচিত হাসা,


যে তোর কথাও মাঝে মাঝে,


তবু আমার মনে জাগে।


বরং উচিত আগে আমার পায়ে


হাত তোর বুলিয়ে দেওয়া;


পরে ধীরে ধীরে নিজের


পিঠের দাগটা মুছে নেওয়া!


পরে বলা ভক্তিভরে,


‘প্রভু! অনুগ্রহ করে,


পৃষ্ঠে ত মেরেছো লাথি,


মারো দেখি পুরোভাগে?


দেখি সেটা কেমন লাগে!’






প্রাচীণ বাংলা বর্ণমালা শিক্ষা


-সীতানাথ বসাক






অ= অসত্ সঙ্গ ত্যাগ কর।


আ= আলস্য দোষের আকর।


ই=ইক্ষুরস অতি মিষ্ট।


ঈ=ঈশ্বর কে বন্দনা কর।


উ=উগ্রভাব ভালো নয়।


ঊ=ঊর্ধ্ব মুখে পথ চলিও না।


ঋ=ঋষিবাক্য শিরোধার্য্য।


এ=একতা সুখের মূল।


ঐ=ঐশ্বর্য্য রক্ষা করা কঠিন।


ও=ওষধি ফল পাকিলে মরে।


ঔ=ঔদার্য্য অতি মহত্ গুন।


ক= কটুবাক্য বলা অনুচিত।


খ= খলকে বিশ্বাস করিও না।


গ= গর্ব করা ভালো নয়।


ঘ=ঘনাগমে বৃষ্টি হয়।


চ=চন্দ্র কিরণ অতি স্নিগ্ধ।


ছ=ছলনা।


জ=জনক জননী অতি পূজ্য।


ঝ=ঝগড়া করিলে বিপদ ঘটে।


ট=টঙ্কার ধনুর জ্যাশব্দ বটে।


ঠ=ঠকের বাক্য অবিশ্বাস্য।


ড=ডমরু শিবের বাদ্যযন্ত্র।


ঢ=ঢক্কা রণবাদ্য বিশেষ।


ত=তপস্বীরা বনে থাকেন।


থ=থপথপ করিয়া ভেক চলে।


দ=দরিদ্রকে অন্নদান কর।


ধ=ধর্মপথ অবলম্বন কর। ন=নম্র


হইতে চেষ্টা কর।


প=পন্ডিত লোক সভামান্য।


ফ=ফল দ্বারা পরিচয় হয়।


ব=বন্ধুর হিত করা কর্তব্য।


ভ=ভগ্নোত্সাহ হইও না।


ম=মন দিয়া বিদ্যাভ্যাস কর।


য=যত্ন করিলে রত্ন মিলে।


র=রবির কিরণ অতি প্রখর।


ল=লম্ফ দিয়া পথ চলিও না।


শ=শঠকে বিশ্বাস করিও না।


ষ= ষড় ঋতুর দেশ বাংলাদেশ।


স=সত্ পুত্র কুলের ভূষণ।


হ=হঠকারিতা বড় দোষ।


ক্ষ=ক্ষমা মহ্ত্ত্বের লক্ষণ।






কাজের ছেলে


- যোগীন্দ্রনাথ সরকার






দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল,চিনি-পাতা দৈ,


দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।


পথে হেঁটে চলি, মনে মনে বলি, পাছে হয় ভুল;


ভুল যদি হয়, মা তবে নিশ্চয়,”


” ছিঁড়ে দেবে চুল।






দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,


দু’টা পাকা বেল, সরিষার তেল, ডিমভরা কৈ।






বাহবা বাহবা – ভোলা ভুতো হাবা খেলিছে তো বেশ!


দেখিব খেলাতে, কে হারে কে জেতে, কেনা হলে শেষ।


দাদখানি চাল, মুসুরির ডাল, চিনি-পাতা দৈ,


ডিম-ভরা বেল, দু’টা পাকা তেল, সরিষার কৈ।






ওই তো ওখানে ঘুরি ধরে টানে, ঘোষদের ননী;


আমি যদি পাই, তা হলে উড়াই আকাশে এখনি!


দাদখানি তেল, ডিম-ভরা বেল, দুটা পাকা দৈ,


সরিষার চাল, চিনি-পাতা ডাল, মুসুরির কৈ!






এসেছি দোকানে-কিনি এই খানে, যত কিছু পাই;


মা যাহা বলেছে, ঠিক মনে আছে, তাতে ভুল নাই!


দাদখানি বেল, মুসুরির তেল, সরিষার কৈ,


চিনি-পাতা চাল, দুটা পাকা ডাল, ডিম ভরা দৈ।






সাহেব ও মোসাহেব


- কাজী নজরুল ইসলাম






সাহেব কহেন, “চমৎকার! সে চমৎকার!”


মোসাহেব বলে, “চমৎকার সে হতেই হবে যে!


হুজুরের মতে অমত কার?”






সাহেব কহেন, “কী চমৎকার,


বলতেই দাও, আহা হা!”


মোসাহেব বলে, “হুজুরের কথা শুনেই বুঝেছি,


বাহাহা বাহাহা বাহাহা!”






সাহেব কহেন, “কথাটা কি জান? সেদিন -”


মোসাহেব বলে, “জানি না আবার?


ঐ যে, কি বলে, যেদিন -”






সাহেব কহেন, “সেদিন বিকেলে


বৃষ্টিটা ছিল স্বল্প।”


মোসাহেব বলে, “আহা হা, শুনেছ?


কিবা অপরুপ গল্প!”






সাহেব কহেন, “আরে ম’লো! আগে


বলতেই দাও গোড়াটা!”


মোসাহেব বলে, “আহা-হা গোড়াটা! হুজুরের গোড়া!


এই, চুপ, চুপ ছোঁড়াটা!”






সাহেব কহেন, “কি বলছিলাম,


গোলমালে গেল গুলায়ে!”


মোসাহেব বলে, “হুজুরের মাথা! গুলাতেই হবে।


দিব কি হস্ত বুলায়ে?”






সাহেব কহেন, “শোনো না! সেদিন


সূর্য্য উঠেছে সকালে!”


মোসাহেব বলে, “সকালে সূর্য্য? আমরা কিন্তু


দেখি না কাঁদিলে কোঁকালে!”






সাহেব কহেন, “ভাবিলাম, যাই,


আসি খানিকটা বেড়ায়ে,”


মোসাহেব বলে, “অমন সকাল! যাবে কোথা বাবা,


হুজুরের চোখ এড়ায়ে!”






সাহেব কহেন, “হ’ল না বেড়ানো,


ঘরেই রহিনু বসিয়া!”


মোসাহেব বলে, “আগেই বলেছি! হুজুর কি চাষা,


বেড়াবেন হাল চষিয়া?”






সাহেব কহেন, “বসিয়া বসিয়া


পড়েছি কখন ঝিমায়ে!”


মোসাহেব বলে, “এই চুপ সব! হুজুর ঝিমান!


পাখা কর, ডাক নিমাইএ”






সাহেব কহেন, “ঝিমাইনি, কই


এই ত জেগেই রয়েছি!”


মোসাহেব বলে, “হুজুর জেগেই রয়েছেন, তা


আগেই সবারে কয়েছি!”






সাহেব কহেন, “জাগিয়া দেখিনু, জুটিয়াছে যত


হনুমান আর অপদেব!”


“হুজুরের চোখ, যাবে কোথা বাবা?”


প্রণামিয়া কয় মোসাহেব।।






শালা আমি তো অবাক


- মোহাম্দ আনোয়ার হোসেন






নিশিরাতে জেগে দেখি,


গাছের ডালে কাক,


শালা আমিতো অবাক!!


চোর ঢুকেছে ঘরের ভেতর,


দরজাছিলো ফাঁক?


শালা আমিতো অবাক!!


মোবাইল


নিলো,


টিভি নিলো, রিমোট না হয় থাক?


শালা আমিতো অবাক!!


পাচ্ছে যা তা নিচ্ছে ভরে, দুই


হাতেরই


মুঠোয় করে, চোরটা তো নির্বাক,


শালা আমিতো অবাক!! সব মালামাল


বস্তা ভরে,


চোর পালালো চুরি করে,


যাক না চলে যাক,


শালা আমিতো অবাক!!


মধ্যরাতে অন্ধকারে, কুত্তা ডাকে জোরে জোরে,


শিয়ালরা দেয় হাক?


শালা আমিতো অবাক!!


ভয়ে শরীর


শিউরে ওঠে,


না জানি আজ কি যে ঘটে?


আবার ডাকে কাক?


শালা আমিতো অবাক!!


হয়নি রাতে তেমন


কিছু,


কোন ভূতই নেয়নি পিছু,


বেঁচে গেছি যাক......


শালা আমিতো অবাক!!


সকালে দেখি পুরো পাড়া,


মারছে সবাই


বেরেক ছাড়া, মানুষ যে ঝাঁক


ঝাঁক!


শালা আমিতো অবাক!!


দেখলাম


আমি মারছে তারা,


চোরটা নাকি পড়ছে ধরা, চোরের মাথায় টাক,


শালা এবারতো আমি পুরাই অবাক!!!!






কেমন বড়াই


হাবীবুর রহমান






লোকটা শুধু করত বড়াই–


‘দেখে নিতাম লাগলে লড়াই !’


উইঢিবিতে মারতো ঘুষি


চোখ পাকিয়ে জোরসে ঠুসি।


বাহু ঠুকে ফুলিয়ে ছাতি


বলত- ‘আসুক বাঘ কি হাতি !


আমি কি আর কারেও ডরাই ?


ভাঙতে পারি লোহার কড়াই।’


শুনে সবে কাঁপত ডরে,


খিল লাগিয়ে থাকত ঘরে।


এক দিন এক ভোরের বেলায়


বেবাক লোকের ঘুম ভেঙে যায়,


ঘর ছেড়ে সব বাইরে এসে


বাড়িয়ে গলা দেখল শেষে;


ঢিবির পাশে বাঁধের গোড়ায়,


লোকটা কেবল গড়িয়ে বেড়ায়।






‘ব্যাপার কি ভাই, ব্যাপার কি ভাই’-


ফিসফিসিয়ে বলল সবাই।


লোকটা তখন চেঁচিয়ে জানায়–


‘উই ধরেছে নাকের ডগায় !’






ঠিক আছে


- সুকুমার বড়ুয়া






অসময়ে মেহমান


ঘরে ঢুকে বসে যান


বোঝালাম ঝামেলার


যতগুলো দিক আছে


তিনি হেসে বললেন


ঠিক আছে ঠিক আছে ।


রেশনের পচা চাল


টলটলে বাসি ডাল


থালাটাও ভাঙা-চোরা


বাটিটাও লিক আছে


খেতে বসে জানালেন


ঠিক আছে ঠিক আছে ।


মেঘ দেখে মেহমান


চাইলেন ছাতাখান


দেখালাম ছাতাটার


শুধু কটা শিক আছে


তবু তিনি বললেন


ঠিক আছে ঠিক আছে ।






নেই


সুকুমার বড়ুয়া






দিনদুপুরে ঘর-ডাকাতি


পানি তোলার লোটাও নেই


সর্ষে-তেলের বোতল গায়েব


তেল তাতে এক ফোঁটাও নেই,


সরু চালের ভাণ্ড উজাড়


চাল তাতে আর মোটাও নেই


তিনটে গেল মিষ্টি কুমোড়


তার কোনো এক বোঁটাও নেই,


ছাগল বাঁধার দড়ি গেছে


দড়ির মাথায় খোঁটাও নেই,


আরেক মাথায় ছাগল ছিল


এখন দেখি ওটাও নেই।






ছত্রচ্ছায়া


সুকুমার বড়ুয়া






ঢাকার পথে চলতে হলে


সারা বছর ধরুন ছাতা,


ওপরতলার ময়লা পানি


কিংবা কাকের কাণ্ড যা-তা।


নিচের দিকে তাকিয়ে দেখুন


ম্যানহোলে বাঁশ আছে গাঁথা,


আরও আছে ইট পাথর কি


মাংস-বর্জ্য পাখির মাথা।






শরীর হলে অপবিত্র


পাবেন না তো কলের পানি,


হুঁশ করে তাই বাইরে যেতে


সঙ্গে নেবেন ছত্রখানি।






ডাটা সংবাদ


সুকুমার বড়ুয়া






পুঁইয়ের ডাঁটা লাউয়ের ডাঁটা


বায়োডাটার ঝোল,


ডাটা প্রসেস করতে হলে


কম্পিউটার খোল।


ডাঁটার পাগল বুড়োবুড়ি


ক্যালসিয়ামে ভরা,


শজনেডাঁটায় গুণ বেশি তাই


বাজার ভীষণ চড়া।দ


উচ্চতর ডিগ্রি নিতে


ডাটাই পরম ধন,


সারা বছর খেটে করেন


ডাটা কালেকশন।


ডালের সাথে মাছের সাথে


যেমন ডাঁটা চলে,


গবেষকের ডাটা আবার


অন্য কথা বলে।






খিদে


লুৎফর রহমান রিটন






আবদুল হাই


করে খাই খাই


এক্ষুনি খেয়ে বলে


কিছু খাই নাই।


লাউ খায় শিম খায়


খেয়ে মাথা চুলকায়


ধুলো খায়


মুলো খায়


মুড়ি সবগুলো খায়


লতা খায় পাতা খায়


বাছে না সে যা-তা খায়


থেকে থেকে খাবি খায়


কত হাবিজাবি খায়


সেদ্ধ ও ভাজি খায়


খেয়ে ডিগবাজী খায়


বকুনি ও গালি খায়


থামে না সে খালি খায়।


গরু খায় খাসি খায়


টাটকা ও বাসি খায়


আম খায়


জাম খায়


টিভি প্রোগ্রাম খায়।


খোলা মাঠে হাওয়া খায়


পুলিশের ধাওয়া খায়


ফুটবল কিক খায়


রক মিউজিক খায়


মিষ্টির হাঁড়ি খায়


জামদানি শাড়ি খায়


ভাত তরকারি খায়


টাকা কাঁড়ি কাঁড়ি খায়।


চকোলেট টফি খায়


শরবত কফি খায়


ঘটি খায় বাটি খায়


চিমটি ও চাঁটি খায়।


হাসি খায় খুশি খায়


ভূষি খায়


ঘুষি খায়


ট্যাংরা ও তিমি খায়


কোল্ড্রিংকস মিমি খায়


বেঞ্চি ও টুল খায়


বিরিয়ানি ফুল খায়


স্বর্ণের দুল খায়


খেয়ে ক্যাপসুল খায়।


গাড়ি খায় বাড়ি খায়


পুলিশের ফাঁড়ি খায়।


গুতো খায়


জুতো খায়


সুঁই খায় সুতো খায়।


তরতাজা হাতি খায়


শরীফের ছাতি খায়


মাঝে মাঝে লাথি খায়।


যা দেখে সে তাই খায়


অ্যাশট্রে ও ছাই খায়


খেতে খেতে খেতে খেতে


পেট হলো ঢোল


তবু তার মুখে সেই


পুরাতন বোল-


কী যে অসুবিধে


খালি পায় খিদে।


আবদুল হাই


করে খাই খাই


এক্ষুনি খেয়ে বলে


কিছু খাই নাই!






হারাধনের দশটি ছেলে


- যোগীন্দ্রনাথ সরকার






হারাধনের দশটি ছেলে


ঘোরে পাড়াময়,


একটি কোথা হারিয়ে গেল


রইল বাকি নয়।






হারাধনের নয়টি ছেলে


কাটতে গেল কাঠ,


একটি কেটে দু’খান হল


রইল বাকি আট।






হারাধনের আটটি ছেলে


বসলো খেতে ভাত,


একটির পেট ফেটে গেল


রইল বাকি সাত।






হারাধনের সাতটি ছেলে


গেল জলাশয়,


একটি সেথা ডুবে ম’ল


রইল বাকি ছয়।






হারাধনের ছয়টি ছেলে


চ’ড়তে গেল গাছ,


একটি ম’ল পিছলে পড়ে


রইল বাকি পাঁচ।






হারাধনের পাঁচটি ছেলে


গেল বনের ধার,


একটি গেল বাঘের পেটে


রইল বাকি চার।






হারাধনের চারটি ছেলে


নাচে ধিন ধিন,


একটি ম’ল আছাড় খেয়ে


রইল বাকি তিন।






হারাধনের তিনটি ছেলে


ধরতে গেল রুই,


একটি খেলো বোয়াল মাছে


রইল বাকি দুই।






হারাধনের দুইটি ছেলে


মারতে গেল ভেক,


একটি ম’ল সাপের বিষে


রইল বাকি এক।






হারাধনের একটি ছেলে


কাঁদে ভেউ ভেউ,


মনের দুঃখে বনে গেল


রইল না আর কেউ।






তোতা পাখি


– যোগীন্দ্রনাথ সরকার






আতা গাছে তোতা পাখি


ডালিম গাছে মউ,


কথা কও না কেন বউ ?


কথা কব কী ছলে,


কথা কইতে গা জ্বলে !






মজার দেশ


– যোগীন্দ্রনাথ সরকার






এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,


রাত্তিরেতে বেজায় রোদ, দিনে চাঁদের আলো !


আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল;


ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা জলের মাঝে চিল !


সেই দেশেতে বেড়াল পালায়, নেংটি-ইঁদুর দেখে;


ছেলেরা খায় ‘ক্যাস্টর-অয়েল’ -রসগোল্লা রেখে !


মণ্ডা-মিঠাই তেতো সেথা, ওষুধ লাগে ভালো;


অন্ধকারটা সাদা দেখায়, সাদা জিনিস কালো !


ছেলেরা সব খেলা ফেলে বই নে বসে পড়ে;


মুখে লাগাম দিয়ে ঘোড়া লোকের পিঠে চড়ে !


ঘুড়ির হাতে বাঁশের লাটাই, উড়তে থাকে ছেলে;


বড়শি দিয়ে মানুষ গাঁথে, মাছেরা ছিপ্ ফেলে !






জিলিপি সে তেড়ে এসে, কামড় দিতে চায়;


কচুরি আর রসগোল্লা ছেলে ধরে খায় !


পায়ে ছাতি দিয়ে লোকে হাতে হেঁটে চলে !


ডাঙ্গায় ভাসে নৌকা-জাহাজ, গাড়ি ছোটে জলে !






মজার দেশের মজার কথা বলবো কত আর;


চোখ খুললে যায় না দেখা মুদলে পরিষ্কার !






বিষম চিন্তা


সুকুমার রায়






মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার


সবাই বলে, ''মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার!''


অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?


বলবে সবাই ''মুখ্য ছেলে'', বলবে আমায় ''গো গর্দভ!''


কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?


বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর?


গাধার কেন শিং থাকে না, হাতির কেন পালক নেই?


গরম তেলে ফোড়ন দিলে লাফায় কেন তা ধেই ধেই?
সোডার বোতল খুললে কেন ফসফসিয়ে রাগ করে?
কেমন করে রাখবে টিকি মাথার যাদের টাক পড়ে?
ভূত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয়?
মাথায় যাদের গোল বেঁধেছে তাদের কেন ''পাগোল'' কয়?
কতই ভাবি এসব কথার জবাব দেবার মানুষ কই?
বয়স হলে কেতাব খুলে জানতে পাব সমস্তই।
--------------------------------------------------------

খুঁজিয়া না পাই নগর পিতাকে,সাঁতরে না কূল,
দক্ষিণে নেই সাঈদ খোকন,উত্তরে আনিসুল....

নিঠুয়া সন্ধায়
কুত্তায় গান গায়
শিয়ালে গিটার বাজায়
গিটারের তালে তালে
মুরগিরা ডিম পাড়ে
সেই ডিম কুত্তায় খায়।।

মাছের রাজা ইলিশ,
ঘুষের রাজা পুলিশ ,
শান্তির রাজা বালিশ ,
ব্যাথার রাজা মালিশ ,
তেলের রাজা সরিষা ,
মেঘের রাজা বারিষা ,
রাস্তার রাজা ট্রাক ,
তরকারির রাজা শাক ,

মাছের মধ্যে রুইমাছ ভালো
শাকের মধ্যে পুঁই
মহিলার মধ্যে সলিমের মাও ভালো
পুরুষের মধ্যে মুই

Comments

Popular posts from this blog

ঢাকার কোথায় কি পাওয়া যায়?

কোন শাক-সবজি ও ফলের কী ভিটামিন?

গবাদি পশুর রোগ ও তার প্রতিকার

কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা