Skip to main content

কুরআন ও হাদিসের আলোকে যাকাতের বিধান!


কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন : 

وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ

‘তাদের এ মর্মে আদেশ করা হয়েছে যে, তারা নিবিষ্ট মনে একান্তভাবে শুধুমাত্র আল্লাহর এবাদত করবে, যথাযথভাবে সালাত আদায় করবে, জাকাত প্রদান করবে, আর এটাই হলো সুপ্রতিষ্ঠিত দ্বীন।’ আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :

وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَقْرِضُوا اللَّهَ قَرْضاً حَسَناً وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ هُوَ خَيْراً وَأَعْظَمَ أَجْراً

‘তোমরা যথানিয়মে সালাত আদায় কর, জাকাত প্রদান কর, আল্লাহ তাআলাকে উত্তম ঋণ দাও, আর তোমরা নিজেদের কল্যাণে যা অগ্রে প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম ও শ্রেষ্ঠ প্রতিদান হিসাবে প্রাপ্ত হবে।’
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :

وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ رِباً لِيَرْبُوَ فِي أَمْوَالِ النَّاسِ فَلا يَرْبُو عِنْدَ اللَّهِ وَمَا آتَيْتُمْ مِنْ زَكَاةٍ تُرِيدُونَ وَجْهَ اللَّهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُضْعِفُونَ

‘তোমরা মানুষের সম্পদ বৃদ্ধির নিমিত্তে যে সুদ ভিত্তিক লেনদেন করে থাক, প্রকৃত পক্ষে তা আল্লাহর নিকট কোন লাভজনক নয়। পক্ষান্তরে তোমরা যে জাকাত প্রদান কর আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়, (তা বৃদ্ধি পায়) ফলত জাকাত প্রদানকারীগণ মুনাফাকে দ্বিগুণ করে নেয়।’

এ ছাড়াও জাকাতের বিধান সংক্রান্ত অসংখ্য আয়াত রয়েছে।

হাদিসের আলোকে জাকাতের বিধান :
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘পাঁচটি জিনিসের ওপর ইসলামের ভিত্তি রাখা হয়েছে। যথা : এ সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই, সালাত আদায় করা, জাকাত প্রদান করা, সিয়াম পালন করা ও হজ সম্পাদন করা।’

এ কথা শুনে একলোক বলল, হজ অতঃপর রমজানের সিয়াম? তিনি বললেন, না, বরং প্রথমে রমজানের সিয়াম, তারপর হজ। এ তারতিবেই আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি।

অন্য এক বর্ণনায় আছে : এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে, ‘এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল।’

সুতরাং বুঝা গেল, জাকাত ইসলামের মৌলিক ভিত্তিগুলোর একটি। কুরআনের অসংখ্য আয়াতে সালাতের পাশাপাশি জাকাতের বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।

ইজমা :
সকল মুসলিম একমত যে, জাকাত একটি ফরজ বিধান। সুতরাং জাকাত ফরজ জেনেও যদি কোন ব্যক্তি তা অস্বীকার করে, তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে। আর যে জাকাত প্রদানে কৃপণতা করবে বা পরিমাণের চেয়ে কম দিবে, সে লাঞ্চনা ও কঠিন শাস্তির উপযুক্ত হবে।

চার ধরনের সম্পদের ওপর জাকাত ফরজ :
প্রথম প্রকার : ভূমি থেকে উৎপাদিত শস্য ও ফল-ফলাদি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَنْفِقُوا مِنْ طَيِّبَاتِ مَا كَسَبْتُمْ وَمِمَّا أَخْرَجْنَا لَكُمْ مِنَ الْأَرْضِ

‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের বৈধ উপার্জন এবং আমি তোমাদের জন্য ভূমি থেকে যে শস্য উৎপন্ন করি তা থেকে আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় কর।’
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :

وآتو حقه يوم حصاده. (الأنعام : ২৬৭)

‘ফসল কাটার সময় তার হক (জাকাত) আদায় কর।’
ফসলের জাকাত প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :

فيما سقت السماء أو كان عثريا العشر وفيما سقى بالنضح نصف العشر.

‘বৃষ্টির পানিতে উৎপন্ন ফসল ও উশরী জমিতে উৎপন্ন ফসলের জাকাত বিশ ভাগের একভাগ।’


ফসলের ওপর জাকাত ওয়াজিব হওয়ার নির্ধারিত পরিমাণ হচ্ছে ‘নিসাব’। পাঁচ ওসকে নিসাব হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

لَيْسَ فِي حَبٍّ وَلَا تَمْرٍ صَدَقَةٌ حَتَّى تَبْلُغَ خَمْسَةَ أَوْسُقٍ.

‘শস্য বা ফলমূল এর ওপর জাকাত ওয়াজিব হবে না, যতক্ষণ তা পাঁচ ওসক পরিমাণ না হয়।’

‘ওসক’ এর পরিমাণ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যবহৃত ৬০ ‘সা’ এর সমপরিমাণ এক ওসক। সে হিসেবে জাকাতের নিসাব হওয়ার জন্য ৩০০ ‘সা’ এর প্রয়োজন। আর এক ‘সা’ সমপরিমাণ ২০৪০ গ্রাম। সুতরাং নিসাব এর পরিমাণ দাড়াল ৬১২ কেজি। তাই এর কম ফসলে মধ্যে জাকাত ওয়াজিব নয়। উক্ত নিসাবে বিনাশ্রমে প্রাপ্ত ফসলে জাকাতের পরিমাণ হল এক দশমাংশ আর শ্রম ব্যয়ে প্রাপ্ত ফসলে জাকাতের পরিমাণ হল এক বিশমাংশ।
ফলমূল, শাক-সব্জি, তরমুজ ও এ জাতীয় বস্তুর ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। ওমর রা.বলেন,

ليس في الخضروات صدقة

‘শাক-সব্জিতে জাকাত নেই।’ আলী রা. বলেন,

ليس في التفاح وما اشبه صدقة

‘আপেল ও এ জাতীয় ফলের ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়।’

যেহেতু এগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার জাতীয় শস্য বা ফল নয়, তাই এর ওপর জাকাত নেই। তবে যদি এগুলো টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয়, যার অংক নিসাব পরিমাণ, তাহলে এ মূল্যের ওপর এক বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর জাকাত ওয়াজিব হবে।

দ্বিতীয় প্রকার : যে সকল প্রাণীর ওপর জাকাত ওয়াজিব হয় তা হল, উট, গরু, ছাগল, ভেড়া ও মহিষ। যদি এ সকল প্রাণী সায়িমা হয় ও মাঠ চড়ে ঘাষ খায় এবং এগুলো বংশ বৃদ্ধির জন্য পালন করা হয় ও তা নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলে এদের জাকাত দিতে হবে। উটের নিসাব ন্যুনতম ৫টি, গরুর ৩০টি, আর ছাগলের ৪০টি।

সায়িমা ঐ সকল প্রাণীকে বলে, যেগুলো সারা বছর বা বছরের অধিকাংশ সময় চারণভূমিতে ঘাস খেয়ে বেড়ায়। যদি এ সকল প্রাণী সায়িমা না হয়, তবে এর ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। কিন্তু ব্যবসার উদ্দেশ্যে পালন করা হলে, সর্বাবস্থায় এগুলোর জাকাত দিতে হবে, যদি তা নিসাব পরিমাণ হয়। আর নিসাবের কম হলে এগুলোর মূল্য অন্য সম্পদের সাথে যুক্ত করে নিসাব পরিমাণ হলে জাকাত দিতে হবে।

তৃতীয় প্রকার : স্বর্ণ- রৌপ্যের ওপর (নিসাব পরিমাণ হলে) সর্বাবস্থায় জাকাত ফরজ।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন :

وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلا يُنْفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُمْ بِعَذَابٍ أَلِيمٍ. يَوْمَ يُحْمَى عَلَيْهَا فِي نَارِ جَهَنَّمَ فَتُكْوَى بِهَا جِبَاهُهُمْ وَجُنُوبُهُمْ وَظُهُورُهُمْ هَذَا مَا كَنَزْتُمْ لانْفُسِكُمْ فَذُوقُوا مَا كُنْتُمْ تَكْنِزُونَ

‘যারা সোনা-রূপা জমা করে রাখে অথচ তা আল্লাহর নির্দেশিত পথে ব্যয় করে না। আপনি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ প্রদান করুন। কিয়ামত দিবসে ঐ সোনা-রূপাকে জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তা দ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্ব ও পৃষ্ঠে ছেকা দেয়া হবে এবং বলা হবে এ হল তোমাদের সে সকল ধন-সম্পদ যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে। সুতরাং আজ জমা করে রাখা সম্পদের স্বাদ গ্রহণ কর।’

সঞ্চয় করে রাখার অর্থ হল, আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিমাণ মত ব্যয় না করা। আর সর্বোত্তম ব্যয় হল- জাকাত প্রদান করা।

এ বিষয়ে আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন 

ما من صاحب ذهب ولا فضة لا يؤدي منها حقها إلا إذا كان يوم القيامة صفحت له صفائح من نار فأحمى عليها في نار جهنم فيكوى بها جنبه وجبينه وظهره كلما بردت أعيدت له في يوم كان مقداره خمسين ألف سنة حتى يقضي بين العباد. رواه مسلم

‘যে সকল সোনা-রূপার মালিকগণ তাদের সম্পদ থেকে নির্ধারিত হক আদায় করে না, কিয়ামত দিবসে তার জন্য কতগুলো আগুনের পাত প্রস্তুত করে তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করে তা দ্বারা ঐ লোকদের ললাট ও পিঠে চেপে ধরা হবে, তাপ কমে গেলে উত্তপ্ত করে পুনরায় চেপে ধরা হবে। পঞ্চাশ হাজার বছর দীর্ঘ সময় বান্দাদের হিসাব-নিকাশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এভাবে শাস্তি চলতেই থাকবে।’
হক আদায় না করার অর্থ হল জাকাত আদায় না করা। যা অন্য রেওয়ায়েতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে।

সোনা-রূপ জাতীয় দিনার, দিরহাম, চাকা বা টুকরা, অলংকারসহ সকল কিছুর ওপরই জাকাত ফরজ, কারণ সোনা-রূপা সংক্রান্ত সকল আয়াত বা হাদীসে এগুলো ব্যাপকভাবে বর্ণিত হয়েছে।
আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আস রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,

أَنَّ امْرَأَةً أَتَتْ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَعَهَا ابْنَةٌ لَهَا وَفِي يَدِ ابْنَتِهَا مَسَكَتَانِ غَلِيظَتَانِ مِنْ ذَهَبٍ فَقَالَ لَهَا أَتُعْطِينَ زَكَاةَ هَذَا قَالَتْ لَا قَالَ أَيَسُرُّكِ أَنْ يُسَوِّرَكِ اللَّهُ بِهِمَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ سِوَارَيْنِ مِنْ نَارٍ قَالَ فَخَلَعَتْهُمَا فَأَلْقَتْهُمَا إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَالَتْ هُمَا لِلَّهِ عَزَّ وَجَلَّ وَلِرَسُولِهِ-رواه النسائي وأبو داؤد

‘একদা একজন মহিলা তার মেয়েকে সাথে নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এল, ঐ মেয়ের হাতে স্বর্ণের দু’টি ভারি ও মোটা বালা ছিল, তা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি এগুলোর জাকাত দাও? মেয়ে বলল, না। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি এটা পছন্দ কর যে কিয়ামত দিবসে আল্লাহ এগুলোর দ্বারা দু’টি আগুনের চুড়ি বানিয়ে তোমার হাতে পড়িয়ে দিবেন? মেয়েটি এ কথা শুনে বালা দু’টি খুলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিয়ে বলল : এগুলো আল্লাহর রাস্তায় দান করলাম।

অন্য এক হাদীসে আয়েশা রাদিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন

دَخَلَ عَلَيَّ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَرَأَى فِي يَدَيَّ فَتَخَاتٍ مِنْ وَرِقٍ فَقَالَ مَا هَذَا فَقُلْتُ صَنَعْتُهُنَّ أَتَزَيَّنُ لَكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ أَتُؤَدِّينَ زَكَاتَهُنَّ قُلْتُ لَا أَوْ مَا شَاءَ اللَّهُ قَالَ هُوَ حَسْبُكِ مِنْ النَّارِ-رواه أبو داؤد

‘একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার নিকট এলেন তখন আমার হাতে কয়েকটি রূপার আংটি ছিল, তখন তিনি বললেন, এগুলো কি? আমি বললাম, আপনার সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করার জন্য এগুলো তৈরি করেছি। তিনি বললেন, তুমি কি এগুলোর জাকাত প্রদান কর? আমি বললাম না, তিনি বললেন, তোমার জাহান্নামে যাওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট।

সোনা-রূপার নিসাব পূর্ণ হলে তার ওপর জাকাত ফরজ :
স্বর্ণের নিসাব হল ২০ দিনার। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

ليس عليك شيئ حتى يكون لك عشرون دينارا

‘সোনা বিশ দিনার পরিমাণ হলে তাতে জাকাত ফরজ হবে।’

দিনার বলতে ইসলামী দিনার উদ্দেশ্য যার ওজন এক মিছকাল। মিছকাল সমান সোয়া চার গ্রাম। সে হিসাবে সোনার নিসাব হল ৮৫ গ্রাম। যা এ দেশীয় মাপে ৭.৫ ভরি হয়। রূপার নিসাব হলো পাঁচ আওকিয়া। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ليس فيما دون خمس اواق صدقة

‘পাঁচ আওকিয়ার কম রূপার ওপর জাকাত নেই।’

এক আওকিয়া সমান ৪০ ইসলামী দিরহাম। সে মতে রূপার নিসাব হল ২০০ দিরহাম। আর এক দিরহাম হল এক মিছকালের সাত দশমাংশ, এর মোট ওজন ১৪০ মিছকাল, যার বর্তমান প্রচলিত ওজন হল, ৫৯৫ গ্রাম। যা এ দেশীয় মাপে ৫২.৫ ভরি, তা থেকে ৪০ ভাগের ১ ভাগ জাকাত দেয়া ফরজ।

কাগজের তৈরি নোটের ওপরও জাকাত ওয়াজিব। কারণ এ নোটগুলো রূপার বদলেই চলমান, সুতরাং এগুলো রূপার স্থলাভিষিক্ত হবে এবং এর মূল্য রূপার নিসাবের সমপরিমাণ হলে, তাতে জাকাত ওয়াজিব হবে।

সোনা-রূপা ও কাগজের নোট ইত্যাদির ওপর সর্বাবস্তায় জাকাত ওয়াজিব। চাই এগুলো হাতে মজুদ থাকুক বা অন্য কারো কাছে ঋণ থাকুক। এ থেকে বুঝা যায়, সব ধরনের ঋণ (চাই তা কর্জ হোক বা বিক্রয়কৃত মূল্য হোক অথবা ভাড়া বা এ ধরনের যাই হোক না কেন) তার ওপর জাকাত ওয়াজিব। উক্ত ঋণ আদায় হওয়া পর্যন্ত প্রতি বছর অন্যান্য সম্পদের সাথে সাথে এগুলোর জাকাত দিতে হবে। এক সাথেও দিতে পারে, যদি ঋণ এমন লোকের কাছে থাকে যে স্বচ্ছল এবং যার থেকে সহজে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

আর যদি দরিদ্র বা প্রতারক লোককে ঋণ দেয়া থাকে, তাহলে ঋণ আদায় হওয়ার পর শুধুমাত্র ঐ বছরের জাকাত প্রদান করবে।

সোনা-রূপা ছাড়া অন্য সকল খনিজ পদার্থের ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়। তবে যদি সেগুলো ব্যবসার জন্য হয়ে থাকে, তবে নিসাব পরিমাণ হলে অবশ্যই জাকাত দিতে হবে।

চতুর্থ প্রকার : ব্যবসায়ী পণ্য। স্থাবর-অস্থাবর সকল প্রকার ব্যবসায়ী পণ্যের ওপর জাকাত ওয়াজিব। বছরান্তে সেগুলোর মূল্য নির্ধারণ করত, তার ৪০ ভাগের এক ভাগ জাকাত দিতে হবে। মেশিনারিজ বা খুচরা যন্ত্রাংশ ও এ জাতীয় ক্ষুদ্র পণ্যের ব্যবসায়ীদের কর্তব্য হল, ছোট-বড় সকল অংশের মূল্য নিধারণ করে নিবে, যাতে কোন কিছু বাদ না পড়ে। পরিমাণ নির্ণয়ে যদি জটিলতা দেখা দেয়, তাহলে সতর্কতামূলক বেশী দাম ধরে জাকাত আদায় করবে, যাতে সে সম্পূর্ণ দায়িত্ত্ব থেকে মুক্ত হতে পারে।

মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু যথা খাবার, পানীয়, আসবাবপত্র, বাহন, পোষাক, (সোনা-রূপা ছাড়া) অলংকারসহ ব্যবহার্য পণ্যের ওপর জাকাত আবশ্যক নয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘মুসলিমদের গোলাম, বাদী, ঘোড়া এগুলোর ওপর জাকাত নেই।’

ভাড়া দেয়ার জন্য প্রস্তুতকৃত পণ্যের ওপর জাকাত আসবে না। তবে সেগুলো থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর নিসাব পূর্ণ হবার পর জাকাত আসবে।

যাকাত ফরজ হয় মক্কাতেই কিন্তু তখন কি কি মালের উপর কি পরিমাণ যাকাত দিতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ নাযিল হয় নাই। যার কারণে সাহাবীগণ নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা থাকতো তার সবই দান করে দিতেন (তাফসীরে মাজহারী)। অতঃপর দ্বিতীয় হিজরীতে মদীনায় এর বিস্তারিত বিবরণ নাযিল হয়। এ কারণে বলা হয় যে, মদীনাতেই যাকাত ফরজ হয়েছে।

এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন মজীদে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং যাকাত আদায় কর' সূরা আল-বাকারা, আয়াত নং-৪৩

মহান আল্লাহ্ আরও বলেন, ‘তারা আল্লাহ্র আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে তাঁর ইবাদত করতে, নামাজ কায়েম করতে ও যাকাত দিতে আদিষ্ট হয়েছিল। এটিই হচ্ছে সোজা-সঠিক দীন'। সূরা আল-বায়্যিনাহ, আয়াত নং-৫

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘পাঁচটি বস্তুর উপর ইসলামের ভিত্তি স্থাপিত। এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ স: তাঁর বান্দা ও রাসূল; নামাজ কায়েম করা; যাকাত আদায় করা; বায়তুল্লাহ্র হজ্জ করা এবং রমযানের রোজা রাখা'। বোখারী এবং মুসলিম শরীফ

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘পাঁচ ওসাকের কম পরিমাণ শস্যের মধ্যে কোন যাকাত নেই, পাঁচ উটের কম সংখ্যায় যাকাত নেই এবং পাঁচ উকিয়ার কমে (রৌপ্য দ্রব্যের জন্য) যাকাত নেই'। মুসলিম শরীফ হাদীস নং-২১৩৫ এবং বোখারী শরীফ হাদীস নং-১৩২৩

উল্লিখিত হাদীস অনুসারে পাঁচ ওসাক বলতে এদেশীয় ওজনে প্রায় সাড়ে সাতাশ মণ এবং হানাফী মতে পাঁচ ওসাকের কমে ফসলের উপর উশর দিতে হবে। www.123muslims.com/zakat/13576-rules-zakat.html'র তথ্য মতে ১১০০ কেজি'র বেশি ফসলকে বুঝানো হয়েছে। এবং পাঁচ উকিয়া হলো তৎকালীন ২০০ দিরহাম আর বর্তমানে সাড়ে ৫২ তোলা রূপার সমান। অর্থাৎ যদি সকল প্রকার খরচ নির্বাহ করার পর নিসাব পরিমাণ সম্পদ/অর্থ ১ বৎসর পর্যন্ত রক্ষিত থাকে তবে তাকে যাকাত দিতে হবে। যে সকল সম্পদের উপর যাকাত দিতে হবে তা সংক্ষিপ্তভাবে নিম্নে তুলে ধরা হলো :

১) সাড়ে ৭ তোলা বা ৮৫ গ্রাম পরিমাণ স্বর্ণ অথবা সাড়ে ৫২ তোলা বা ৫৯৫ গ্রাম পরিমাণ রৌপ্য। অথবা সমপরিমাণ ৭৪,৩৭৫ টাকা (জুলাই ২১,২০১২ ইং তারিখের বাজার দর অনুযায়ী রৌপ্য ৯৯.৯ ক্যারেট ৫২.৫০ তোলা * ১৪৫৮ =৭৬,৫৪৫ টাকা অথবা ৫৯৫ গ্রাম * ১২৫/-=৭৪,৩৭৫ টাকা আমরা এই দুইয়ের মধ্যে যেটি কম সেটি হিসাবে নিতে পারি)। এখানে স্বর্ণের মূল্য অনেক বেশি, যার কারণে স্বর্ণকে টাকার হিসাবে আনা হলো না। শুধু স্বর্ণের উপর যাকাতের ক্ষেত্রে ওজন করার সময় যদি পাথর সম্পৃক্ত তৈরী হয় তাহলে ২% এবং শুধু স্বর্ণ দিয়ে তৈরী হলে ২৫% বাদ দেয়া যাবে। সকল ক্ষেত্রে যাকাত দিতে হবে ২.৫%।

(উল্লেখ্য যে আমাদের দেশের আলেমগণ এক তোলাকে এক ভরি হিসেবে বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছেন। এখানে ভরি হিসাবে ৭৬,৫৪৫ টাকা হয় এবং কিলোগ্রাম/গ্রাম হিসাবে করলে ৭৪,৩৭৫ টাকা হয়। এখানে খুবই সামান্য পার্থক্য, সুতরাং আমরা কম যেটি সেটিকে হিসাবে নিতে পারি।)

২) সমপরিমাণ অর্থের সেভিংস সার্টিফিকেট, কোম্পানি শেয়ার, ফিক্সড ডিপোজিট (এফডিআর), ডিপিএস, বিদেশী মুদ্রা ইতাদি যার পরিমাণ ৭৪,৩৭৫ টাকা বা এর চেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে যাকাত দিতে হবে ২.৫%।

৩) ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে কোন পশু বা জমি ক্রয় অথবা অন্য কোন খাতে বিনিয়োগ যা উল্লিখিত অর্থের সমপরিমাণ। এ ক্ষেত্রে যাকাত দিতে হবে ২.৫%।

৪) কৃষি পণ্যের উৎপাদন যদি ১১০০ কেজির বেশি হয় তাহলে উশর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃতির সহযোগীতায় উৎপাদন হলে ১০% এবং সেচের মাধ্যমে উৎপাদন হলে ৫% উশর দিতে হবে। কিন্তু কিছু সেঁচ এবং কিছু বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত হলে ৭.৫% উশর দিতে হবে। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত ফুলও যদি হয় তাহলে তা যাকাতের অন্তর্ভুক্ত হবে। কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে ১ বৎসরের বিষয়টি বিবেচিত হবে না। উৎপাদিত পণ্যকেই হিসাবে আনতে হবে।

এক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ)'র একটি হাদিস উল্লেখ করা যেতে পারে। আমর ইবনে হারিস থেকে বর্ণিত, আবু যুবায়ের তাঁর কাছে বর্ণনা করেছেন, তিনি জাবির ইবনে আব্দুল্লাহকে আলোচনা করতে শুনেছেন, তিনি নবী (সাঃ) কে বলতে শুনেছেন, ‘যে জমি নদী-নালা ও পানিতে সিক্ত হয় তাতে উশর (উৎপাদিত শষ্যের ১০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত) ধার্য হয়। আর যে জমিতে উটের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হয় তাতে অর্ধেক উশর (বিশ ভাগের এক ভাগ) ধার্য হয়'। মুসলিম শরীফ হাদীস নং-২১৪৪

এখানে উল্লেখ্য যে, যাকাত অবশ্যই সঠিকভাবে হিসাব করে দিতে হবে। অনুমানের উপর ভিত্তি করে যাকাত দেয়া যাবে না। যদি কেউ অনুমানের উপর ভিত্তি করে যাকাত প্রদান করে তাহলে সেটা যাকাত আদায় হবে না, সাদকা হিসেবে বিবেচিত হবে। সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই ইসলাম তথা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পন্থায় যাকাতের হিসাব করতে হবে।

যাকাত না দেয়ার পরিণাম সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চিত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তাদের কঠিন শাস্তির সুসংবাদ প্রদান করেন। যে দিন সেসব (স্বর্ণ ও রৌপ্য) দোযখের আগুনে উত্তপ্ত এবং তদ্বারা তাদের ললাট, পার্শ্বদেশ ও পৃষ্ঠদেশে দাগ দেয়া হবে এবং বলা হবে, এ সবকিছু তাই যা তোমরা দুনিয়াতে নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে, সুতরাং যা তোমরা সঞ্চয় করে রেখেছিলে এখন তার স্বাদ গ্রহণ কর'। সূরা তওবাঃ আয়াত ৩৪-৩৫

এ সম্পর্কে মহানবী (সাঃ)'র দুইটি হাদীস উল্লেখ করা হলোঃ হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী করীম (সাঃ) বলেন, ‘উটের যা হক (যাকাত) রয়েছে, যদি উটের মালিক তা আদায় না করে, তবে কেয়ামতের দিন সে উট পূর্বের চেয়ে অধিক মোটাতাজা অবস্থায় তার মালিকের নিকট উপস্থিত হবে এবং খুর দ্বারা তাকে পিষ্ট করতে থাকবে। তদ্রূপ বকরীর যা হক রয়েছে তার মালিক যদি তা আদায় না করে তবে কেয়ামতে ঐ বকরী পূর্বাপেক্ষা অধিক শক্তিশালী অবস্থায় মালিকের নিকট উপস্থিত হয়ে খুর দ্বারা তাকে দলন করতে এবং শিং দ্বারা গুঁতাতে থাকবে। নবী করীম (সাঃ) আরও বলেন, সেটির হকসমূহের একটি হল, পানি পান করাবার স্থানে দোহন করা এবং দরিদ্রদের মাঝে তা বণ্টন করা। নবী করীম (সাঃ) আরও বলেন, কেয়ামতের দিন তোমাদের কাউকে যেন চিৎকাররত অবস্থায় বকরী কাঁধে বহন করে উপস্থিত হতে না হয় এবং বলতে না হয়, হে মুহাম্মদ (সাঃ)! আমায় রক্ষা করুন। আর আমাকেও যেন বলতে না হয়, আল্লাহর শাস্তি থেকে তোমাকে রক্ষা করার জন্য আজ আমি কিছুই করতে পারি না। আমি তো আল্লাহর হুকুম আগেই জানিয়ে দিয়েছি। আর তোমাদের কাউকে যেন চিৎকাররত কোন উট কাঁধে বহন করে উপস্থিত হতে না হয় এবং বলতে না হয়, হে মুহাম্মদ (সাঃ)! আমায় রক্ষা করুন এবং আমাকেও বলতে না হয়, তোমার ব্যাপারে আজ আমার কিছুই করার এখতিয়ার নেই। আমি তো আল্লাহর হুকুম আগেই জানিয়ে দিয়েছি।' বোখারী শরীফ হাদীস নং-১৩২০

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে আরও একটি বর্ণনায় আসছে যে, নবী করীম (সা.) বলেন, ‘যাকে আল্লাহ ধন-সম্পদ দান করেছেন, কিন্তু সে এর যাকাত আদায় করেনি, কিয়ামতের দিন তার সম্পদকে (বিষের তীব্রতার কারণে) টেকো মাথা বিশিষ্ট বিষধর সাপের আকৃতি দান করে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার মুখের দু'পার্শ্ব কামড়ে ধরে বলবে, আমি তোমার সম্পদ, আমি তোমার জমাকৃত মাল। তারপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তিলাওয়াত করেনঃ আল্লাহ যাদেরকে সম্পদশালী করেছেন অথচ তারা সে সম্পদ নিয়ে কার্পণ্য করেছে, তাদের ধারণা করা উচিত নয় যে, সেই সম্পদ তাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে, বরং তা তাদের জন্য কিয়ামত দিবসে, অচিরেই অকল্যাণকর হবে যা কার্পণ্য করছে তা দিয়ে তাদের গলদেশ শৃংখলাবদ্ধ করা হবে'। বোখারী শরীফ হাদীস নং-১৩২১

সুতরাং এখানে স্পষ্ট যে কেয়ামতের সেই কঠিন দিনে আমাদের প্রিয় নবীর শাফায়েত ছাড়া কেউ পার হতে পারবে না, কিন্তু সেদিন যাকাত না দেয়ার কারণে নবী (সাঃ)'র শাফায়েত থেকে এরা বঞ্চিত হবে। অতএব এখন থেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে যে, আমাদের উপর ধার্যকৃত যাকাত সঠিকভাবে হিসাব করে পরিশোধ করব।

আর একটি বিষয় না বল্লেই নয়। আমরা যাকাতের নামে শাড়ি-লুঙ্গি বিতরণ করি। কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় এ সব শাড়ি-লুঙ্গি ব্যবহারের উপযোগীও নয়। অনেক সময় গ্রহীতারা এ গুলো নিতে এসে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে মৃত্যুবরণ করে। অনেক দোকানে ঝুলানো থাকে এখানে যাকাতের শাড়ি বিক্রি করা হয়। ইসলামে এ ধরণের কোন বিধান নেই। রাসূল (সা.) ও সাহাবাদের সময় এমন ঘটনার কোন নজীর নেই। যারা যাকাতের নামে এ ধরনের প্রতারণা করে তাদের যাকাত আদায়তো দূরে থাক, উল্টা এই প্রতারণাই হতে পারে কাল কিয়ামতের দিন তার কঠিন শাস্তির কারণ। ধনীদের সম্পদে যে গরীবের হক রয়েছে তা আগে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তাকে ঐ সম্পদ/অর্থ সম্পূর্ণরূপে দিয়ে দিতে হবে, ঐ অর্থের মধ্যে তাদের পূর্ণ মালিকানা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এর পর সে মালিক হওয়ার পর সে অর্থ দিয়ে তার প্রয়োজন মেটাবে।

আমরা আবার আমাদের যাকাতের অর্থ একটু একটু করে অনেক জনকে দিয়ে থাকি। যা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে যাকাত গ্রহীতার তেমন কোন উপকার হয় না। যাকাতের মূল উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য হ্রাস করা, ক্ষুধাকে চিরতরে বিদায় করা। তাই যদি হয় তাহলে যাকাত দাতাগণ এক একজন বা তার সামর্থ সংখ্যক যাকাত গ্রহীতাকে টার্গেট করে এক বছরের মধ্যে স্বাবলম্বী করে তোলার পরিকল্পনা করতে পারে, যাতে তার আর আগামী বছর যাকাত নিতে না হয়। বরং সে যেন আগামী বছর অন্যজনকে যাকাত দিতে পারে। আমরা যাকাত যে কোন সময় দিতে পারি। কিন্তু যদি রমজান মাসে দিতে পারি তাহলে রমযান মাস কোরআন নাযিলের মাস হিসেবে ৭০ গুণ ছওয়াব বেশি পাব। সুতরাং আমরা রমজান মাসকে যাকাত প্রদানের জন্য উত্তম সময় হিসেবে বিবেচনা করতে পারি।

যাকাত মূলত ৮ ব্যক্তিকে দেয়া যাবে যা সংক্ষিপ্তাকারে নিম্নে তুলে ধরা হলো-

১. গরিব বা ফকীরঃ যাদের কাছে কিছু না কিছু ধন-সম্পদ আছে কিন্তু তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য যথেষ্ঠ নয়, খুবই টানাটানির ভেতর দিয়ে যাদের জীবন অতিবাহিত হয়, তদুপরি কারও কাছে কিছু চাইতে পারে না, এরা গরিব।


২. মিসকীনঃ যে সব লোকের অবস্থা আরও খারাপ, পরের কাছে হাত পাততে বাধ্য হয়, নিজের পেটের অন্নও যারা যোগাড় করতে পারে না তারা মিসকিন।

৩. যাকাত আদায় ও বণ্টন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গঃ ইসলামী রাষ্ট্র যাকাত আদায়ের জন্য যাদের কর্মচারী নিয়োগ করবে তাদেরকেও যাকাতের অর্থ থেকে বেতন দেয়া হবে।

৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন বা আল্লাহ্র দ্বীনের জন্য যে সব লোকের মন জয় করা প্রয়োজনঃ ইসলামের সহায়তার জন্য কিংবা ইসলামের বিরোধিতা বন্ধ করার জন্য যাদেরকে টাকা দেয়ার প্রয়োজন তারা এর অন্তর্ভুক্ত। সেই সকল নও-মুসলিমও এর অন্তর্ভুক্ত যাদের সমস্যা মুক্ত করা একান্ত অপরিহার্য।

৫. গোলাম ও কয়েদীদের মুক্তি বিধান বা দাসমুক্তকরণ : যে ব্যক্তি দাসত্ব শৃংখলে বন্দী হয়ে আছে এবং যে মুক্তি পেতে চায় তাকেও যাকাতের অর্থ দিয়ে মুক্ত করা যাবে।

৬. ঋণগ্রস্ত লোক : যে সব লোক ঋণী অথবা ঋণ আদায় করার সম্বলও যাদের নেই, তাদেরও যাকাতের টাকা দ্বারা ঋণ ভার থেকে মুক্তি দেয়া যাবে। কিন্তু তাই বলে কারও কাছে হাজার টাকা থাকলেও সে যদি একশ টাকার ঋণ হয় তাহলে তাকে কোন অবস্থাতে যাকাত দেয়া যাবে না।

৭. আল্লাহ্র পথে : আল্লাহর পথে শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক। মুসলমানদের সমস্ত নেক কাজেই যাকাতের টাকা ব্যয় করা যেতে পারে। কিন্তু বিশেষ করে এর অর্থ হচ্ছে-আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের সাহায্য করা। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন যে, ধনী ব্যক্তির পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয নয় কিন্তু ধনী ব্যক্তিই যদি জিহাদের জন্য সাহায্য গ্রহণ করতে বাধ্য হয, তবে তাকেও যাকাত দিতে হবেঃ কারণ এই যে, এক ব্যক্তি ধনী হতে পারে; কিন্তু জিহাদের জন্য যে বিরাট ব্যয় আবশ্যক, তা শুধু নিজের অর্থ দ্বারা পূরণ করতে পারে না। তার এ কাজের জন্য যাকাতের টাকা সাহায্য করা যাবে। এবং

৮. নিঃস্ব পথিক বা মুসাফিরদেরকে : পথিক বা প্রবাসীর নিজ বাড়িতে যত ধন-সম্পদ থাকুক না কেন, কিন্তু পথে বা প্রবাসে সে যদি অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে তাকে যাকাতের টাকা দিতে হবে।

পরিশেষে আমি বলতে চাই; আমরা সকলে যদি যাকাত গ্রদান করতে পারি তাহলে দেশে আর দরিদ্র্যতা থাকবে না। আসুন আমাদের যাদের উপর যাকাত ফরজ তারা সবাই মিলে যাকাত গ্রদান করি, ধনীদের সম্পদে গরীবের হক প্রতিষ্ঠিত করে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমাই, ব্যক্তি, সমাজ তথা রাষ্ট্র গঠনে অবদান রাখি। আল্লাহ্ আমাদের তৌফিক দান করুন!

এসএম মাসুদুল ইসলাম
লেখক : ইসলামী চিন্তাবিদ

Comments

Popular posts from this blog

ঢাকার কোথায় কি পাওয়া যায়?

কোন শাক-সবজি ও ফলের কী ভিটামিন?

গবাদি পশুর রোগ ও তার প্রতিকার

কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা