Skip to main content

ইসলাম ও গণতন্ত্র


ভূমিকা

'গণতন্ত্র' একটি অতি পরিচিত রাজনৈতিক মতবাদ। এর চিন্তাধারা ও ঐতিহ্য সূপ্রাচীন। প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে অদ্যবধি পর্যন্ত গণতন্ত্র বিভিন্ন যুগে বিচিত্রভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। গণতন্ত্রের সুবিধা আর অসুবিধা নিয়ে আছে যথেষ্ট আলোচনা-সমালোচনা। বেশিরভাগ মুসলমানরা যেখানে নিজের ধর্ম সম্পর্কে সচেতন না সেখানে ইসলাম ও গণতন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্ক না জানা স্বাভাবিক। অনেকে তো গণতন্ত্রকে সরাসরি হারাম বলে ঘোষণা দিয়ে দেয়। নিচে আমি কুরআনের আলোকে ইসলাম ও গণতন্ত্রের মধ্যকার সম্পর্ক তুলে ধরছি।

প্রথমেই বলে নিচ্ছি সকল মুসলমানকে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হবে যে, ইসলাম পূর্নাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থা (Al-Maaida:3)। অর্থাৎ এতে জীবনের সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে। অতএব, নেতা নির্বাচন সম্পর্কে ও ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতি রয়েছে।

গণতন্ত্রের সুবিধা ও অসুবিধাঃ
সুবিধাসমূহঃ
১. সহিংসতা ছাড়া ক্ষমতার পরিবর্তন।
২. সংখ্যাগরিষ্ট জনগনের আশা আকাংখার প্রতিফলন।
৩. সরকার জনগণের মন রক্ষা ও বিরোধীদলের সমালোচনার জন্য সর্বাত্মক উন্নয়ন করে।
৪. জনগণ মত প্রকাশের সুযোগ পায়।

অসুবিধাসমূহঃ
১. দেশের সকল মানুষ সচেতন না থাকলে ভুল মানুষ নেতা হয়।
২. দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করা সম্ভব হয়না।
৩. নির্বাচনে কারচুপি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
৪. সংখ্যালঘুদের স্বার্থ রক্ষা হয়না।
৫. বিরোধীদলের বিরোধিতার কারণে কাজ বাস্তবায়নে প্রচুর সময় ব্যয় হয়।
৬. ভোটাধিকার নির্ধারণের মাপকাঠি বয়স হলে অনেক সময় মূর্খরা অপাত্রে ভোট দেয়।
৭. দলীয় প্রভাবের কারণে খারাপ মানুষ নির্বাচিত হতে পারে।

ইসলাম কি বলে?
যারা গনতন্ত্র হারাম বলেছেন তারা বলেন তারা নিচের আয়াত পেশ করেন-

আর যদি আপনি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নেন, তবে তারা আপনাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে। তারা শুধু অলীক কল্পনার অনুসরণ করে এবং সম্পূর্ণ অনুমান ভিত্তিক কথাবার্তা বলে থাকে -Al-An'aam: 116
আর যারা গণতন্ত্র(শর্তসাপেক্ষে) হালাল বলেছেন তারা বলেন-
যারা তাদের পালনকর্তার আদেশ মান্য করে, নামায কায়েম করে; পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে এবং আমি তাদেরকে যে রিযিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে” -Ash-Shura: 38

আল্লাহর রহমতেই আপনি তাদের জন্য কোমল হৃদয় হয়েছেন পক্ষান্তরে আপনি যদি রাগ ও কঠিন হৃদয় হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কাজেই আপনি তাদের ক্ষমা করে দিন এবং তাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করুন এবং কাজে কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোন কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তা’আলার উপর ভরসা করুন আল্লাহ তাওয়াক্কুল কারীদের ভালবাসেন। -Aal-imraan: 159

“পারস্পরিক পরামর্শক্রমে কাজ করে”, “কাজে কর্মে তাদের পরামর্শ করুন” এখানের কাজে কি নেতা নির্বাচন আসেনা?

এখানে যে ৩টি আয়াত দেয়া হয়েছে সেগুলো দেখলে বুঝা যায়-
১ম. আল্লাহ সকলের পরামর্শ(মত/ভোট) নিতে নিষেধ করেছেন।
২য়. যারা আল্লাহর আদেশ মান্য করে, নামায কায়েম করে অর্থাৎ মুমিন তারা ভোট/মত দিতে(পরামর্শ করতে) পারবে।
৩য়. নবীজি আল্লাহর বানী পাওয়া সত্তেও মুমিনদের সাথে পরামর্শ করেছেন/আল্লাহ করতে বলেছেন।

ডালাও ভাবে গণতন্ত্র হারাম বললে নেতা কিভাবে নির্বাচিত হবে? রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র, পীরতন্ত্র?

ইসলামী গণতন্ত্র
অনেকে ইসলামী গণতন্ত্র শব্দটি ব্যবহারের বিরোধিতা করে বলেন, ইসলাম শুধুই ইসলাম। এর সাথে আর কিছুই নেই। আমি এ বিষয়ে একমত। ইসলামে যাবতীয় সমস্যার উত্তম সমাধান রয়েছে আর সকল সমাধান মিলেই ইসলাম। ইসলামী গণতন্ত্র শব্দটি কেন ব্যবহার করা হয়েছে বা কেন বলা যাবে তা ব্যাখ্যা করছি। মূলত সাধারণ/ আধুনিক/ পশ্চিমা গণতন্ত্র আর ইসলামের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক পার্থক্য। তাই বলে ইসলামে গণতন্ত্রের চর্চা নেই তা নয়। সাধারণ গণতন্ত্রের সুবিধা-অসুবিধা আছে কিন্তু ইসলাম যে গণতন্ত্রের শিক্ষা দেয় তার অসুবিধা নেই বললেই চলে।

ইসলামের ক্ষেত্র ব্যাপক, তেমনি গণতন্ত্রের ও রয়েছে অনেক রূপ। যেমনঃ
Anticipatory, Athenian, Consensus, Deliberative, Demarchy, Direct, Economic, Grassroots, Illiberal, Inclusive, Liberal, Messianic, Non-partisan, Participatory, Radical, Representative, Representative direct, Republican, Social, Sociocracy, Soviet, Totalitarian....
সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের একক কোন সংজ্ঞা নেই, একেক জন একেক ধরনের সংজ্ঞা দিয়েছেন। যারা গণতন্ত্রকে হারাম বলেন তারা শুধু একটি সংজ্ঞাই জানেন, আর তা হল-

“গণতন্ত্র হল জনগণের সরকার, জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকার, এবং জনগণের জন্য গঠিত সরকার”

অতএব, গণতন্ত্র হারাম!
কিন্তু এটাতো শুধু আব্রাহাম লিঙ্কনের (Abraham Lincoln) বক্তব্য। তিনি তার দুমিনিটকাল স্থায়ী ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বরে প্রদত্ত গেটিসবার্গ বক্তৃতায় বলেন :That Government of the people, by the People, for the People, shall not perish from the earth.

আমি যদি বলি সঙ্গীত হারাম না হালাল? কি উত্তর দেবেন?
সঙ্গীতের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হচ্ছে- "গীত,বাদ্য ও নৃত্যূ - এই তিনটিকে একত্রে সংগীত বলে।" এটা বিভিন্ন সংস্কৃত ভাষার বইতে উল্লেখ করা হয়েছে (গীতং বাদ্যং তথা নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীতমুচ্যতে)। এই সংজ্ঞামতে সঙ্গীত হারাম। তা যে ধরনেরই হোক।

কিন্তু সঙ্গীতের আরও একটি সংজ্ঞা হচ্ছে - "স্বর ও তালবদ্ধ মনোরঞ্জক রচনাকে বলা হয় সংগীত।" এই সংজ্ঞানুযায়ী শর্তসাপেক্ষে তা হালাল হতে পারে।

তেমনি গণতন্ত্র আব্রাহাম লিঙ্কনের প্রতিষ্ঠিত কোন মতবাদ নয়। ইসলামের যে অংশটুকু গণতন্ত্রের শিক্ষা দেয় তাকে আমরা ইসলামী গণতন্ত্র বলতে পারি। যেমন সঙ্গীতের যে অংশটুকু ইসলামী অনুশাসন লঙ্গন করে না, তাকে আমরা ইসলামী সঙ্গীত বলতে পারি।

গণতন্ত্রের ইংরেজি প্রতিশব্দ  democracy। democracy শব্দটির প্রথম প্রয়োগ হয় খ্রিস্টপূর্ব পাঁচ শতকে। জনগণের শাসন এ অর্থে প্রয়োগ করেন গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস (Herodotus)। মূলগত অর্থে democracy আসে demos (জনগণ) এবং Kratein বা Kratia (শাসন বা ক্ষমতা) থেকে। ইংরেজি ভাষায় democracy শব্দটির প্রথম প্রয়োগ হয় ষোল শতকে। ফরাসি শব্দ democratia থেকে এসেছে ইংরেজি শব্দ democracy, যদিও এর মূল গ্রিক শব্দদ্বয় demos এবং Kratein। সেই থেকে গণতন্ত্র বা democracy-এর ব্যবহার।

এথেন্সের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ পেরিক্লিস (Pericles) মতেঃ আমাদের শাসনকে গণতন্ত্র বলে চিহ্নিত করি এজন্য যে, শাসন ব্যবস্থার দায়িত্ব ন্যস্ত রয়েছে বহুজনের উপর, কতিপয় ব্যক্তির উপর নয় (We are called a democracy because the administration is in the hands of the many and not in the few)। অ্যারিস্টটল তাঁর Politeia গ্রন্থের চতুর্থ অংশের ষাট অনুচ্ছেদে বলেন : সাধারণভাবে আমরা বলতে পারি, যে ব্যবস্থায় প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়নি তা কুলীনতন্ত্র এবং যেখানে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে তা গণতন্ত্র (We may lay down generally that a system which does not allow every citizen to share is oligarchical and that one which does so is democratic)। এসব সংজ্ঞা ছাড়াও বিভিন্ন লেখক গণতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছেন বিভিন্ন রূপে। কেউ বলেছেন গণতন্ত্র সম্মতির সরকার (Government by consent)। কেউবা বলেছেন, গণতন্ত্র জনগণের সার্বভৌমত্ব (sovereignty of the people)। কারও মতে, গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন (rule by the majority)। কেউ আবার গণতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছেন সীমিত সরকাররূপে (Limited government)। এসবই গণতন্ত্রের সংক্ষিপ্ত সংজ্ঞা।

এসব সংজ্ঞায় গণতন্ত্রের মর্মবাণী অনুরণিত হয় বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের অবয়ব সুস্পষ্ট হয় না। যে কোন একটির বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হলে অন্তর্নিহিত বিভ্রান্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধরা যাক, গণতন্ত্র জনগণের শাসন। প্রকৃতপক্ষে জনগণ কোথাও শাসন করেনি এবং করে না। জনগণের শাসন করার ক্ষমতাও নেই। পেরিক্লিস জনগণের শাসন সম্পর্কে আবেগজড়িত কণ্ঠে বিবৃতি দিলেও তিনি জানতেন, জনগণ বলতে যা বোঝায় তারা কোনো সময়ে শাসনকাজের সাথে জড়িত ছিলেন না। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর এথেন্সের দিকে তাকালে চলবে। তখন এথেন্সের জনসংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ। জনসমষ্টির প্রায় অর্ধেকই ছিল ক্রীতদাস এবং যুদ্ধবন্দি। ক্রীতদাসদের শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে ছিল না কোনো অধিকার। শাসনকাজ পরিচালনায় কোনো অধিকার ছিল না মহিলাদের। তারা ছিলেন মুক্ত জনসমষ্টির প্রায় অর্ধেক। সমাজে শিশু-কিশোরদের অংশও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। ফলে হিসেব করে দেখা গেছে, এথেন্সের প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল হাজার দশেকের মতো। অ্যারিস্টটলের কথায়, তারাই ছিলেন এথেন্সের নাগরিক। নাগরিকদের প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে পেরিক্লিস বলেছেন, জনগণের শাসন।

যদি বলা হয়, গণতন্ত্র সম্মতির শাসন ব্যবস্থা, সম্মতিভিত্তিক সরকার তবু এ শব্দগুলোকে বিশ্লেষণ করলেও দেখা দেবে অসংখ্য অসঙ্গতি। প্রশ্ন উঠবে কাদের সম্মতি নিয়ে সরকার? কোন বিষয়ে সম্মতি? কতদিনের জন্য সম্মতি? কারা সম্মতি নেবেন? এই বিভ্রান্তির মধ্যে সম্মতির সরকার হিসেবে গণতন্ত্রের রূপরেখা হয়ে ওঠে অত্যন্ত অস্পষ্ট।

এজন্য একেক দেশে একেক রকম গণতন্ত্র চালু রয়েছে। আর বাস্তবতা হল ইসলামের মধ্যে একরকমের গণতন্ত্র চর্চা করা হয়েছে। এটাই সঠিক এবং বাকি গুলো হারাম। সঙ্গীতের মধ্যে যেগুলো হালাল সেগুলোকে যেমন আমরা ইসলামী সঙ্গীত বলতে পারি তেমনি ইসলামে যে গণতান্ত্রিক শিক্ষা (যা ইসলামের বাইরে নয়, বরং ইসলাম যা শেখায়) রয়েছে তাকে আমরা ইসলামী গণতন্ত্র বলতে পারি (সামগ্রিকভাবে শুধুই ইসলাম)।

Comments

Popular posts from this blog

ঢাকার কোথায় কি পাওয়া যায়?

কোন শাক-সবজি ও ফলের কী ভিটামিন?

গবাদি পশুর রোগ ও তার প্রতিকার

কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা