ওল চাষের খুঁটিনাটি
প্রাক আর্য ভাষা ‘ওল্ল’ থেকে এসেছে ওল। ওল বাংলাদেশের একটি অন্যতম অর্থকরী কচুজাতীয় সবজি। এ দেশের প্রায় সব এলাকাতেই ওলের চাষ হয়। তবে সাতক্ষীরা, খুলনা, যশোর, কুমিল্লা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে বেশ উৎকৃষ্টমানের ওল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। ফাল্গুন-চৈত্র মাস ওল লাগানোর উপযুক্ত সময়।
গাছের বর্ণনা :
ওল মাটির নিচে জন্মানো একটি গুঁড়িকন্দ। ওলের গুঁড়িকন্দ গোলাকার বা লম্বাটে বিভিন্ন আকারের হতে পারে। কন্দের শীর্ষ ভাগ অনেকটা চাকতির মতো। প্রতিটি কন্দের ব্যাস ১০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার হতে পারে। ২০ কেজি ওজনেরও ওল বাজারে দেখা যায়। পাতার বোঁটা সরাসরি মাটি থেকে বের হয়। এটিকে অনেকে তাকে কাণ্ড বলে ভুল করেন। বোঁটা ওপরের দিকে কয়েকটি শাখায় বিভক্ত হয়ে পাতাগুলোকে দু’দিকে সাজায়। কন্দের বা চাকির আকার যত বড় হয় গাছ ও পাতার আকারও তত বড় হয় এবং ওলের আকারও সেভাবে আনুপাতিক হারে বাড়ে। পাতা যৌগিক। শীতকালে পাতা মরে যায়, কিন্তু মাটির নিচে কন্দ সুপ্ত অবস্খায় থাকে। পরে মৌসুমে বা শীতশেষে কন্দের কেন্দ্র থেকে পাতা বের হয়। মাটি থেকে কন্দ না তুলে রেখে দিলে কয়েক বছরে অনেক বড় ওল পাওয়া যায়। ওলগাছের অনেক বৈশিষ্ট্যই ভিন্ন ধরনের। তেমনি এর মূল বা শিকড়ও ওঠে মাটির ওপরের দিকে, নিচের দিকে শিকড় যায় না। কিন্তু কখনো মাটির ওপরে ওঠে না। এ দেশে বিভিন্ন জাতের ওল পাওয়া যায়। এর মধ্যে ‘মাদ্রাজি’জাত সর্বোৎকৃষ্ট। যথাযথ গবেষণার অভাবে এখনো উচ্চফলনশীল কোনো জাত এ দেশে উদ্ভাবিত হয়নি।
চাষপদ্ধতি :
ওলের জন্য পানি দাঁড়ায় না এমন উঁচু জমি দরকার। ছায়া থাকলে ভালো হয় না। বেলে-দো-আঁশ মাটিতে ওল ভালো বাড়ে। লাভজনকভাবে ওল উৎপাদন করতে হলে বিশ্বস্ত জায়গা বা ব্যক্তির কাছ থেকে ভালো জাতের বিচন ‘চাকি’ সংগ্রহ করতে হবে। ওলের বীজ হিসেবে রোপণ দ্রব্যকে ‘চাকি’ বলে। আর নিজেই যদি চাকি তৈরি করতে পারেন তাহলে সেটাই সবচেয়ে ভালো হয়। জমি থেকে সাধারণত কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে ওল তোলা শুরু হয়। তখন ওলের চার পাশে যে মুখী জন্মে, সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে। এসব মুখী থেকেই চাকি তৈরি হয়। যথাসম্ভব বড় আকারের মুখীগুলো বেছে নিয়ে সেগুলো কিছু বালু ও মাটি মিশিয়ে আলো-বাতাসপূর্ণ ছায়া জায়গায় মাটিতে বিছিয়ে রাখতে হবে। এসব মুখী চৈত্র-বৈশাখ মাসে ভালো করে চাষ করা জমিতে ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার গভীর মাটিতে রোপণ করতে হবে। রোপণের দূরত্ব সারি থেকে সারি ৩০ সেন্টিমিটার রাখা যেতে পারে। মুখীর আকার বড় হলে এ দূরত্ব আরো কিছুটা বাড়ানো যেতে পারে। চারা গজানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর প্রতি শতক জমির জন্য ৩০০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম এমওপি ও ১.২ কেজি টিএসপি সার মাটির সাথে ভালো করে মিশিয়ে পিলি তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনীয় সেচের ব্যবস্খাও করতে হবে। এসব মুখী কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের দিকে পরিপক্ব হয়ে ‘চাকি’তে পরিণত হবে। আগের মতোই এসব চাকি সংরক্ষণ করলে চৈত্র-বৈশাখ মাসের দিকে এসব চাকি থেকে অঙ্কুর গজাবে।
চার থেকে পাঁচটি চাষ দিয়ে ওলের জমি তৈরি করতে হবে। তারপর লাগানোর নকশা তৈরি করতে হবে। সাধারণত ওলের জন্য সারি থেকে সারির দূরত্ব এক মিটার দেয়া হয়। তবে চাকির আকার বা ওজন অনুযায়ী চাকি থেকে চাকির দূরত্ব প্রতি সারিতে ভিন্ন হয়। এ জন্য সংগৃহীত চাকিগুলো মোটামুটি একই আকার বা ওজনের হলে ভালো হয়। তা না হলে আকার বা ওজন অনুযায়ী চাকিগুলোকে দুই থেকে তিনটি গ্রেডে ভাগ করে জমিতে বপনের ব্যবস্খা নিতে হবে। যেমন ২০০ থেকে ৪০০ গ্রাম ওজনের চাকির জন্য রোপণ দূরত্ব হবে ১.৭৫ মিটার, ৪০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের চাকির জন্য ১.৯ মিটার, ৮০০ গ্রাম ওজনের ঊর্ধ্বে হলে চাকির জন্য দুই মিটার দূরত্ব দেয়া যেতে পারে। আগেই বলা হয়েছে, চাকির আকার যত বড় হয় উৎপাদিত ওলের আকারও তত বড় হয়। তাই বলে খুব বড় বিশেষত ৮০০ গ্রামের অধিক ওজনের চাকি লাগানো আনুপাতিক হারে লাভজনক নয়। ২৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের চাকি রোপণের ও ফলনের জন্য সবচেয়ে ভালো।
রোপণ দূরত্ব অনুযায়ী চাষ দেয়া জমিতে গর্ত করতে হবে। গর্তের আকারও চাকির আকার অনুযায়ী কম-বেশি করতে হয়। ‘চাকি’ অনুযায়ী ২০ থেকে ৫০ সেন্টিমিটার গভীর করে গর্ত করতে হবে। গর্তের ব্যাস ১৫ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার হতে পারে। গর্তের নিচে অল্প ছাই দিয়ে তার ওপর চাকিটি বসিয়ে দিতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে ‘চাকি’র মুখ যেন সোজা আকাশের দিকে থাকে। তারপর গর্ত থেকে তোলা মাটির সাথে সার মিশাতে হবে। সারের মাত্রা একর প্রতি ৩০ কেজি ইউরিয়া, ১২০ কেজি টিএসপি, ৫০ কেজি এমওপি। প্রতি গর্তের মাটিতে কী পরিমাণ সার মিশাতে হবে তা নির্ভর করবে একর প্রতি গর্তের সংখ্যার ওপর। মোট সারের পরিমাণকে একর প্রতি গর্তের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে গর্তপ্রতি সারের পরিমাণ বের করে নিতে হবে। সার মিশানো মাটি দিয়ে গর্ত ভরাট করতে হবে। ভরাট করার সময় লক্ষ রাখতে হবে যেন মাটিতে ভালো ‘জো’ থাকে। ভরাটের পর গর্তের মুখ মাটি দিয়ে সামান্য উঁচু করে ঢিবির মতো করে দিতে হবে। এতে সুবিধা হলো, গর্তের মধ্যে অনেক সময় বৃষ্টির পানি জমে ‘চাকি’ পচে যায়। ঢিবি তৈরির ফলে এ সম্ভাবনা কমে যায়। ‘চাকি’ থেকে মাটির ওপরে চারা বেরিয়ে আসতে বেশ সময় লাগে। তাই এ সময় সব জমি খড় বা কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে রাখলে ভালো হয়। জমিতে সালফারের অভাব থাকলে একরপ্রতি ২০ কেজি জিপসাম সার এবং সুযোগ থাকলে ১০০ কেজি ছাই ব্যবহার করলে সুফল পাওয়া যায়।
চারা গজানোর পর চারা যাতে ভালোভাবে মাটির ওপরে পাতা ছড়াতে পারে সে জন্য কচুরিপানা বা খড় মুখের কাছে সামান্য আলগা করে ঢেকে দিতে হবে। চারা গজানোর এক মাস পর একরপ্রতি ২৫ কেজি ইউরিয়া ও ২০ কেজি এমওপি সার সেচের পর গাছের চারপাশে খড় বা কচুরিপানার নিচে দিতে হবে। কিছু দিন পর গোড়ার মাটি হালকা করে কুপিয়ে দেয়া যেতে পারে। তবে লক্ষ রাখতে হবে এতে শিকড় যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। ‘চাকি’ ক্রমশ ওপরের দিকে বাড়তে থাকে। অনেকেই বলে থাকেন, ওলের আকার-আকৃতি অনেকটা গর্তের আকারের ওপর নির্ভর করে।
লেখক: মৃত্যুঞ্জয় রায়
তথ্যসূত্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত
খবর: মেহেরপুরে চাষ হচ্ছে মাদ্রাজি ওল : দিন দিন বাড়ছে এ ওল চাষ।
মেহেরপুরে বানিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ হচ্ছে মাদ্রাজি ওল। পতিত ও বেলেদোঁয়াশ মাটিতে এই ওলের চাষ করে আর্থিকভাবে বেশি লাভ করছে চাষীরা। ফলে জেলায় দিন দিন বাড়ছে এই জাতের ওল চাষ।
কৃষি অফিস সুত্রে জানাগেছে, গত কয়েক বছর ধরে মেহেরপুর জেলায় চাষ হচ্ছে মাদ্রাজি ওল। বিঘাপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ করে ৭০-৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘরে তুলছে চাষীরা। এবার আবহাওয়া ভাল থাকায় প্রতিটি গাছ থেকে ১০-২০ কেজি পর্যন্ত ওলের ফলন পাচ্ছে চাষী। এছাড়া বাজারে চাহিদার পাশাপশি দামও ভাল। এই আবাদে বেশি লাভ হওয়ায় জেলায় দিন দিন বাড়ছে এই জাতের ওল চাষ। কৃষি বিভাগের হিসেবে এবছর জেলায় ২০ হেক্টর জমিতে ওল চাষ হয়েছে। এই ওলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চাষীরা বীজ বিক্রি করে অতিরিক্ত লাভ করছে।
কৃষি অফিস সুত্রে জানাগেছে, গত কয়েক বছর ধরে মেহেরপুর জেলায় চাষ হচ্ছে মাদ্রাজি ওল। বিঘাপ্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ করে ৭০-৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘরে তুলছে চাষীরা। এবার আবহাওয়া ভাল থাকায় প্রতিটি গাছ থেকে ১০-২০ কেজি পর্যন্ত ওলের ফলন পাচ্ছে চাষী। এছাড়া বাজারে চাহিদার পাশাপশি দামও ভাল। এই আবাদে বেশি লাভ হওয়ায় জেলায় দিন দিন বাড়ছে এই জাতের ওল চাষ। কৃষি বিভাগের হিসেবে এবছর জেলায় ২০ হেক্টর জমিতে ওল চাষ হয়েছে। এই ওলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চাষীরা বীজ বিক্রি করে অতিরিক্ত লাভ করছে।
সদর উপজেলার রাজনগর গ্রামের জাহাঙ্গির হোসেন জানান, তিনি গতবছর দেড় বিঘা জমিতে এই জাতের ওল চাষ করে দেড় লাখ টাকা ঘরে তুলেছে। এবছর তার চার বিঘা জমিতে ওল চাষ করেছে। সে আশা করছে ৪ লাখ টাকার ওল বিক্রির।
সদর উপজেলার আমঝুপি গ্রামের ওল চাষী ফয়েজ উদ্দীন জানান, ওল বিক্রির পাশাপাশি শুধু বীজ বিক্রি করেই তিনি ৫৫ হাজার টাকা আয় করেছে। প্রতিমন বীজ এক হাজার থেকে এক হাজার দুই’শ টাকায় বিক্রি করেছেন।
কৃষি বিভাগের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই জাতের ওল চাষ চাষীদের কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছে। বাজারে চাহিদার পাশাপাশি দামও ভাল। চাষীদের এই আগ্রহটাকে আরোবেগবান করতে চাষীদের উদ্বুদ্ধকরনের পাশাপাশি বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আশা করা যায় আগামীতে এই জাতের ওল চাষ আরো বাড়বে।
Comments
Post a Comment