ঝিনুক শিল্প আমাদের দেশে একটি সম্ভাবনাময় শিল্পের নাম। এ দেশে ঝিনুক চাষের রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা। ঝিনুক থেকে পাওয়া যায় মহামূল্যবান বস্তু ‘মুক্তা’। বিশ্বব্যাপী অমূল্য রত্নরাজির ক্ষেত্রে হীরার পরই মুক্তার স্থান। যা প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়। প্রাণিবিজ্ঞানের পরিভাষায় মোলাস্কা পর্বের (অখন্ড দেহ ম্যান্টল দ্বারা আবৃত) কয়েকটি প্রাণীর দেহ নিঃসৃত পদার্থ জমাট বেঁধে যে পদার্থ সৃষ্টি হয় তাই ‘মুক্তা’ নামে পরিচিত। আর এ সৃজন কর্মটি সম্পন্ন হয় ঝিনুকের দেহ অভ্যন্তরে। সেজন্য মুক্তার চাষ দেশের জন্য বয়ে আনতে পারে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। সেই সঙ্গে সৃষ্টি করতে পারে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ। মুক্তা চাষকে সেমি কালচার বলে। আমাদের দেশে বেশ কয়েক বছর থেকে মুক্তার চাষ শুরু হলেও চীনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বছর আগে থেকে এর চাষ হয়ে আসছে। মুক্তা চাষের ক্ষেত্রে বর্তমানে জাপানের অবস্থান শীর্ষে। এছাড়াও ফিলিপাইন, ফ্রান্স, ইতালি, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, স্পেন প্রভৃতি দেশও মুক্তা উৎপাদনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে এ দেশের মুক্তাবাহী ঝিনুক থেকে সংগৃহীত মুক্তা বিশ্ববাজারে উৎকৃষ্ট মানসম্পন্ন বলে স্বীকৃত। সারা বিশ্বে অসংখ্য প্রজাতির ঝিনুক দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে পিস্কটাডা মাটেনসি, পিস্কটাডা ম্যাক্সিমা, পিস্কটাডা মার্গারিটিপেরা, টোরিয়া, টোরিয়া ভালগারিস, লেমিলিডেন্স, সারজিনলি, ইউনিট, প্লেকুরাপ্লানসেটা ইত্যাদি প্রজাতির ঝিনুক থেকে উন্নতমানের মুক্তা পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের নোনা পানিতে ৩০০ প্রজাতির এবং মিঠা পানিতে ২৭ প্রজাতির ঝিনুক রয়েছে। তবে বাংলাদেশে ৫ ধরনের ঝিনুকে মুক্তা হয়। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলার খাল-বিল, পুকুর-ডোবা, দিঘি এবং স্রোতহীন নদী-নালায় মুক্তা বহনকারী ঝিনুক পাওয়া যায়। এর মধ্যে বৃহত্তর ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর ও চট্টগ্রামে উন্নতমানের গোলাপি মুক্তা পাওয়া যায়। আমাদের দেশে দুই ধরনের মুক্তা যথা- ‘গোলাপি’ ও ‘চুর’ মুক্তার মধ্যে গোলাপি মুক্তাই উন্নতমানের এবং এর কদর বেশি। অমূল্য রত্ন হিসেবে বিশ্বব্যাপী রয়েছে এর খ্যাতি।
আর চুর মুক্তা আয়ুর্বেদীয় ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার হয়ে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রয়েছে এ মুক্তার জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের আবহাওয়া, মাটি ও পানি ঝিনুকে মুক্তা জন্মানোর জন্য যথেষ্ট অনুকূল হওয়া সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে মুক্তা উৎপাদনের জন্য ঝিনুক চাষ তেমন ব্যাপকতা লাভ করেনি। অথচ বর্তমানে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তার যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। ফলে এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মুক্তার চাষ শুরু হয়েছে। প্রকৃতিগতভাবে ঝিনুকে মুক্তার চাষ করতে হলে মিঠা পানির ভালো প্রজাতির ‘লেমিলিডেন্স মারজিনালিস’ নামক লম্বাটে ফোলা বা একটু মোটা ধরনের ঝিনুক সবচেয়ে ভালো। তবে মিঠা পানির ঝিনুকেই নয়, সামুদ্রিক ঝিনুকেও মুক্তা চাষ করা যেতে পারে। অফশোর শিপিং কোম্পানি নামে একটি সংস্থার তত্ত্বাবধানে ১৯৭৬ সালে দুই জাপানি বিশেষজ্ঞ কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায় জরিপ চালিয়ে অভিমত ব্যক্ত করেন এটি মুক্তা আহরণের জন্য একটি সম্পদ ভান্ডার, পরিকল্পিত উপায়ে এ ভান্ডার থেকে মুক্তা আহরণ করতে পারলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এটি বিরাট অবদান রাখবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি প্রণোদিত উপায়ে ঝিনুকে মুক্তার চাষ করা হয় তাহলে দেশে প্রতি বছর একটন পর্যন্ত গোলাপি মুক্তা উৎপাদন করা সম্ভব। যার বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। তাছাড়া শুধু কুতুবদিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত এলাকায় বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষের মাধ্যমে প্রতি বছর ২০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলেও বিশেষজ্ঞদের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়। এছাড়াও আমাদের দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল, যেমন- কক্সবাজার, মহেশখালী, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া, কুতুবদিয়া, চিড়িংগা, পটুয়াখালীতে সামুদ্রিক ঝিনুক থেকে বিভিন্ন ধরনের মূল্যবান সামগ্রী তৈরি হচ্ছে। ঝিনুকের মূল্যবান ও আকর্ষণীয় সামগ্রীর মধ্যে লাইটশেড, ঝাড়বাতি, পর্দা, চাবির রিং, টেবিল ল্যাম্প, ঝাড়, ফুল, অ্যাশট্রে, কানের দুল, মালা, হাতের চুড়ি, চুলের ক্লিপসহ বিভিন্ন ধরনের পুতুল, পশু-পাখির মূর্তি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ঝিনুকের এসব সামগ্রীর কদর দিন দিন বাড়ছে। ঝিনুকের তৈরি নিত্যনতুন ডিজাইনের সামগ্রী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করছে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঝিনুক সামগ্রীর চাহিদাও রয়েছে। আজকাল শুধু ঝিনুকের সামগ্রীই নয় ঝিনুকের মাংসেরও যথেষ্ট চাহিদা ও কদর রয়েছে। ঝিনুক থেকে পান খাওয়ার চুন তৈরি করা হয়। ঝিনুকের গুঁড়া মৎস্য ও পোলট্রি ফার্মে খাবার হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে আমাদের দেশে ঝিনুক একটি সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিণত হয়েছে। কিন্তু নানা অবহেলা আর অযত্নের কারণে এ শিল্পটি আজ পরিপূর্ণ শিল্পের মর্যাদা লাভ করতে পারছে না। তাই এ শিল্পের দিকে গুরুত্ব দিলে এ থেকে প্রতি বছর প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হবে এবং সেই সঙ্গে অনেক বেকারও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে।
লেখক: খোন্দকার এরফান আলী বিপ্লব
Comments
Post a Comment