Skip to main content

মুসলিম বিশ্ব : ধর্ম ও রাজনীতি


মুসলিম বিশ্ব : ধর্ম ও রাজনীতি
-ড. আহমদ আবদুল কাদের

মুসলিম বিশ্ব প্রায় অর্ধশতাধিক রাষ্ট্রের সমন্বিত নাম। এসব রাষ্ট্রের জনগণের সাধারণ ধর্ম ইসলাম হলেও সে দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ফেরকা, মাজহাব ও জাতিগত পার্থক্য। আবার রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের সাথে ইসলামের সম্পর্কও সর্বত্র এক ধরনের নয়। অর্থাৎ ধর্ম ও রাজনীতির দিক দিয়ে রয়েছে ব্যবধান। ফলে ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে মুসলিম বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে ও ভূমিকা পালনে এখন অপারগ। তারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নানা যড়যন্ত্র ও চক্রান্তের শিকার। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি।

দেশগুলোর ধর্মীয় ফেরকাভিত্তিক অবস্থান : বর্তমান মুসলিম বিশ্বের তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছে, যারা কোনো না কোনো রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু অংশ। এ তিনটি সম্প্রদায় হচ্ছে- সুন্নি, শিয়া ও ইবাদি। এদের মধ্যে সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হচ্ছে ৪৫টি, শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হচ্ছে পাঁচটি, ইবাদি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র একটি।

ক. শিয়া রাষ্ট্রগুলো :
পাঁচটি শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সবই ইসনা আশারিয়া শিয়া। এগুলো হচ্ছে-

১. ইরান : ৯০-৯৫ শতাংশ : ইসনা আশারিয়া/জাফরি ফিকাহ; বাকিরা সুন্নি হানাফি মাজহাবভুক্ত।
২. ইরাক : ৬৫-৭০ শতাংশ : ইসনা আশারিয়া/জাফরি ফিকাহ; বাকিরা সুন্নি হানাফি মাজহাবভুক্ত।
৩. আজারবাইজান : ৬৫-৭০ শতাংশ : ইসনা আশারিয়া/জাফরি ফিকাহ; বাকিরা সুন্নি হানাফি মাজহাবভুক্ত।
৪. লেবানন : ৪৫-৫০% : ইসনা আশারিয়া/জাফরি ফিকাহ; বাকিরা হানাফি মুসলিম ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ভুক্ত।
৫. বাহরাইন : ৬০ শতাংশ : শিয়া ইসনা আশারিয়া/জাফরি ফিকাহ, সুন্নি ২৫ শতাংশ। তবে শাসক পরিবার সুন্নি।

উল্লেখ্য, উত্তর ইয়েমেনের প্রায় সবাই জায়েদিয়া শিয়া। কিন্তু ১৯৯০ সালে উত্তর ও দক্ষিণ ইয়েমেন একীভূত হওয়ার পর দেশটি সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠে পরিণত হয়েছে। এখন সেখানে জায়েদিয়া প্রায় ৪০ শতাংশ। বাকিরা সুন্নি শাফেয়ি মাজহাবভুক্ত।

খ. ইবাদি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র :
ইবাদি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রটি হচ্ছে ওমান। ওমানের ৯০-৯৫ শতাংশ জনগণ ইবাদি সম্প্রদায়ভুক্ত। ইবাদিরা মূলত খারেজি সম্প্রদায়ের একটি শাখা। খারেজিদের সর্বাধিক নরমপন্থী শাখা হচ্ছে ইবাদিয়া। বর্তমানে তাদের ফিকাহ ও ধর্মতত্ত্বের সাথে সুন্নিদের, বিশেষত হানাফিদের খুব একটা তফাৎ নেই। বাকি জনসংখ্যা ৫-১০ শতাংশ শিয়া জাফরি ফিকাহভুক্ত।

গ. সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র :
সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র ৪৫টি। এর মধ্যে ১৪টি হানাফি, আটটি শাফেয়ি, ২০টি মালেকি, দু’টি হাম্বলি মাজহাবভুক্ত আর একটি (মিসর) হানাফি, শাফেয়ি ও মালেকি মাজহাবভুক্ত। নিম্নে মাজহাবওয়ারি দেশের তালিকা দেয়া হলো-

হানাফি মাজহাবভুক্ত দেশ :
১. পাকিস্তান : হানাফি : ৮৫-৯০ শতাংশ, শিয়া : ১০-১৫ শতাংশ, ২. বাংলাদেশ (বাংলাদেশে হানাফি ছাড়াও আহলে হাদিস সম্প্রদায়ভুক্তরাও রয়েছেন), ৩. তুরস্ক : ৮৫-৯০ শতাংশ : হানাফি, আলাভি শিয়া : ১০-১৫ শতাংশ; ৪. আফগানিস্তান : হানাফি ৮৫-৯০ শতাংশ, শিয়া : ১০-১৫ শতাংশ; ৫. উজবেকিস্তান; ৬. সিরিয়া : হানাফি : ৮০-৮৫ শতাংশ, আলাভি শিয়া : ১৫-২০ শতাংশ; ৭. কাজাখস্তান; ৮. কিরগিজিস্তান; ৯. তুর্কমেনিস্তান; ১০. তাজিকিস্তান, ১১. আলবেনিয়া : সুন্নি হানাফি ৯০ শতাংশের বেশি; শিয়া ৫ শতাংশের কম; ১২. ফিলিস্তিন; ১৩. কসোভো ও ১৪. উত্তর সাইপ্রাস।

শাফেয়ি মাজহাবভুক্ত দেশগুলো :
১. ইন্দোনেশিয়া, ২. মালয়েশিয়া, ৩. ইয়েমেন : শাফেয়ি : ৬০-৬৫ শতাংশ, জায়েদি শিয়া : ৩৫-৪০ শতাংশ, ৪. সোমালিয়া, ৫. জর্ডান, ৬. জিবুতি, ৭.ব্রুনাই ও ৮. মালদ্বীপ।

মালেকি মাজহাবভুক্ত দেশগুলো :
১. নাইজেরিয়া, ২.আলজেরিয়া, ৩. মরক্কো, ৪. সুদান, ৫. নাইজার, ৬.বারকিনা ফাসো, ৭. মালি, ৮.সেনেগাল, ৯. তিউনিসিয়া ১০. গিনি, ১১. সিয়েরালিওন, ১২. লিবিয়া, ১৩. আরব আমিরাত : মালেকি ৯০ শতাংশ, শিয়া : ১০ শতাংশ, ১৪. শাদ, ১৫. কুয়েত : সুন্নি মালেকি ৭৫-৮০ শতাংশ, শিয়া ২০-২৫ শতাংশ, ১৬ মৌরিতানিয়া, ১৭. গাম্বিয়া, ১৮. কমোরোস, ১৯.পশ্চিম সাহারা ও ২০. মায়োটি।

হাম্বলি মাজহাবভুক্ত দেশগুলো :
১. সৌদি আরব : হাম্বলি ৮৫-৯০ শতাংশ, শিয়া : ১০-১৫ শতাংশ এবং ২.কাতার : সুন্নি হাম্বলি ৯০ শতাংশ, শিয়া ১০ শতাংশ।

একই সাথে তিন মাজহাবভুক্ত দেশ : মিসর : শাফেয়ি/মালেকি/হানাফি

মুসলিম দেশগুলোতে রাষ্ট্র ও ইসলামের সম্পর্ক:
ইসলামের সাথে মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক সর্বত্র এক নয়। ইসলামি রাষ্ট্র/ইসলামি প্রজাতন্ত্র থেকে শুরু করে সেকুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা- সবই মুসলিম বিশ্বে রয়েছে। বস্তুত সাংবিধানিক বিচারে দেশগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা যায় : ১. ইসলামি রাষ্ট্র : সাংবিধানিকভাবে ইসলামি প্রজাতন্ত্র বা যেখানে শরিয়াহকে আইনের উৎস বা প্রধান উৎস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ২. ইসলাম দেশের রাষ্ট্রধর্ম : যেখানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু শরিয়াহ অনুসরণের বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। এখানে আরো উল্লেখযোগ্য, যেসব দেশকে ইসলামি রাষ্ট্র বলা হয়, সেগুলোরও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। ৩. ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার রাষ্ট্র : সাংবিধানিকভাবে যেখানে ইসলাম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ করা হয়েছে। তবে সে ধরনের রাষ্ট্রে ধর্মসংক্রান্ত দফতর ও কার্যক্রম থাকতে পারে। ৪. অস্পষ্ট রাষ্ট্র :যেখানে রাষ্ট্রধর্মও ঘোষণা হয়নি আবার সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রও ঘোষণা করা হয়নি।

সাংবিধানিকভাবে ইসলামি রাষ্ট্র :
মুসলিম বিশ্বের ১৮টি দেশকে কম-বেশি ইসলামি রাষ্ট্র বলা যেতে পারে। দেশগুলো হচ্ছে-
১. ইরান : ১৯৭৯ সালে একটি গণবিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ইরান একটি ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক দেশ। এখানে শিয়া জাফরি ফিকাহ অনুসরণ করা হয়।

২. সৌদি আরব : সৌদি আরব মূলত মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহ্হাব প্রবতির্ত ইসলামি আন্দোলনের সূত্র ধরে আলে সৌদ বা সৌদ পরিবাবের প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখানে শরিয়াহ আইন কার্যকর রয়েছে। সৌদি জনগণ প্রধানত হাম্বলি মাজহাবভুক্ত।

৩. আফগানিস্তান : ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে প্রায় এক লাখ সৈন্য পাঠিয়ে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান দখল করে নেয়। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত দখলদারির বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদদের সংগ্রাম বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে এখানে মূলত শরিয়াহভিত্তিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে পরে মার্কিন আক্রমণ ও তালেবান সরকারের পতনের পর এখানে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রতি অনুগত একটি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে দেশের সাংবিধানিক অবস্থার তেমন মৌলিক কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

৪. মৌরিতানিয়া : সাংবিধানিকভাবে এটি একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র। সেখানে কিছু অপরাধের জন্য শরিয়াহ আইনের প্রয়োগ রয়েছে।

৫. ইয়েমেন : ইয়েমেনের সর্বশেষ সংবিধান অনুযায়ী, ইয়েমেনের আইনের উৎস হিসেবে শরিয়াহকে গ্রহণ করা হয়েছে।

৬. পাকিস্তান : ইসলামের নামে অর্থাৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। সাংবিধানিকভাবে পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিছু শরিয়াহ আইন ও হুদুদ আইন চালু আছে।

৭. মালদ্বীপ : সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রটি ইসলামি নীতিমালার ভিত্তিতে গঠিত। শরিয়াহর নীতিমালা আইনের অন্যতম শর্ত। মালদ্বীপের দণ্ডবিধিতে হুদুদ প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে, যদিও এর প্রয়োগ অনেকটাই বিরল।

৮. কাতার : কাতারের আইনের প্রধান উৎস শরিয়াহ। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইন ছাড়াও সেখানে দণ্ডবিধিতে শরিয়াহ আইন চালু রয়েছে।

৯. সুদান : সুদানের আইনের ভিত্তি হচ্ছে শরিয়াহ। কিছু অপরাধের জন্য শরিয়াহ আইন চালু রয়েছে।

১০. ব্রুনাই : নতুন আইন প্রবর্তনের পর থেকে (২২ এপ্রিল ২০১৪) অনেক অপরাধের ক্ষেত্রেই শরিয়াহ আইন চালু করা হয়েছে।

১১. ইরাক : ২০০৬ সালে গৃহীত, স্থায়ী সংবিধান অনুযায়ী দেওয়ানি আইনের আনুষ্ঠানিক উৎস হচ্ছে শরিয়াহ। ১৯৯৫ সালে সাদ্দাম হোসেনের সময়ে কিছু অপরাধের জন্য শরিয়াহ আইন চালু করা হয়েছিল। বর্তমান সংবিধান অনুসারে শরিয়াহর অকাট্য বিধানের পরিপন্থী কোনো আইন প্রণয়ন ও চালু করা যাবে না। কার্যত ব্যক্তিগত বিষয়গুলোতে শরিয়াহ প্রয়োগ করা হয়। মূলত ইরাকে আমেরিকান কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে দরকষাকষি ও সমঝোতার মাধ্যমেই বর্তমান সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়েছে।

১২. বাহরাইন : ২০১২ সালের সংবিধান অনুযায়ী বাহরাইনের আইনের প্রধান উৎস হচ্ছে শরিয়াহ।

১৩. ওমান : সংবিধান অনুযায়ী, ওমানে শরিয়াহভিত্তিক বিভিন্ন আইন চালু রয়েছে।

১৪.কুয়েত : কুয়েতের সংবিধান অনুযায়ী শরিয়াহ হচ্ছে আইনের প্রধান উৎস।

১৫. আরব আমিরাত : দুবাই ও রাস্আল খাইমা ছাড়া বাকি রাজ্যগুলোতে সিভিল কোর্টের পাশাপাশি শরিয়াহ আদালতও রয়েছে। সেখানে হুদুদ আইনেরও কম-বেশি প্রয়োগ রয়েছে।

১৬. লিবিয়া : লিবিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও শরিয়াহ আইন প্রণয়নের প্রধান উৎস।

১৭. গাম্বিয়া : ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে গাম্বিয়াকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী, দেশটি এখনো একটি সেকুলার রাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত এটি স্পষ্ট নয়, সেকুলার সংবিধান পরিবর্তনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হবে কি না।

১৮. মিসর : ২০১৪ সালের সংবিধান অনুযায়ী মিসরের আইনের প্রধান উৎস শরিয়াহ। কার্র্র্যত মিসরে ব্যক্তিগত আইনের ক্ষেত্রে শরিয়াহ প্রয়োগ ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে শরিয়াহর তেমন একটা প্রয়োগ নেই। তদুপরি সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার এখানে প্রতিষ্ঠিত আছে।

তা ছাড়া, নাইজেরিয়া একটি সেকুলার ফেডারেশন হলেও এর ২৪টির মধ্যে ১২টি প্রদেশে এবং ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে শরিয়াহ আইন চালু রয়েছে। অধিকন্তু, প্রায় সব মুসলিম দেশেই ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আইনের ক্ষেত্রে শরিয়াহ বলবৎ রয়েছে।

ওপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট, ১৮টি দেশে শরিয়াহকে আইনের উৎস বা প্রধান উৎস বলা হলেও এর মধ্যে বেশ কিছু দেশে রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সেখানে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার তেমন নেই। কিছু দেশে কম-বেশি ইসলামপন্থীরা সরকার চালাচ্ছেন। নীতিগতভাবে দেশগুলোকে ‘ইসলামি’ বলা হলেও সুশাসন, রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সফলতার পরিচয় কমই দিতে পেরেছে। ইসলামের আলোকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সর্বক্ষেত্রে মানবিক মর্যাদা ও অধিকার, ইনসাফ, মানুষের কল্যাণ ও সাম্য প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি রোধ কল্পে এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জিত হয়নি। কাজেই সুশাসন ও উন্নয়নই হচ্ছে কথিত ইসলামি রাষ্ট্রগুলোর সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ।

ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম :
বর্তমানে প্রায় ২৭টি মুসলিম দেশে (ইসলামি রাষ্ট্রসহ) রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে, সেগুলো হচ্ছেÑ ১. বাংলাদেশ, ২. জিবুতি, ৩. ইরাক, ৪. পাকিস্তান, ৫. ফিলিস্তিন, ৬. তিউনিসিয়া, ৭. আফগানিস্তান, ৮. আলজেরিয়া, ৯. ব্রুনাই, ১০. কমোরস, ১১. মিসর, ১২. জর্ডান, ১৩. লিবিয়া, ১৪. মালদ্বীপ, ১৫. মালয়েশিয়া, ১৬. মৌরিতানিয়া, ১৭. মরক্কো, ১৮. পাকিস্তান, ১৯. কাতার, ২০. সৌদি আরব, ২১. সোমালিয়া, ২২. সংযুক্ত আরব আমিরাত, ২৩. ইরান, ২৪. ওমান, ২৫. কুয়েত, ২৬. ইয়েমেন, ২৭. বাহরাইন, ২৮. সুদান ও ২৯.সিরিয়া।

এর মধ্যে ১৮টি দেশ সাংবিধানিকভাবে ইসলামি রাষ্ট্র। কিন্তু গাম্বিয়া ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হলেও এখন পর্যন্ত দেশের সংবিধান সেকুলারই রয়ে গেছে। আর বাকি ৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে সেকুলার দেশ আবার সাংবিধানিকভাবেই ইসলাম এখানকার রাষ্ট্রধর্ম। অন্য আটটি দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের মাধ্যমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় পরিচয়কে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে মাত্র। অবশ্য কোনো কোনো দেশে ইসলামের সুস্পষ্ট বিধান বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন না করার অঙ্গীকারও করা হয়েছে।

সেকুলার/ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র :
যেখানে সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হয়েছে। বর্তমানে প্রায় ১৬টি মুসলিম রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। সেগুলো হচ্ছে- ১. নাইজেরিয়া, ২. তুরস্ক, ৩. উজবেকিস্তান, ৪. তাজিকিস্তান, ৫. নাইজার, ৬. বারকিনা ফাসো, ৭. মালি, ৮. সেনেগাল, ৯. গিনি, ১০. আজারবাইজান, ১১. কিরগিজিস্তান, ১২. তুর্কমেনিস্তান, ১৩. শাদ, ১৪. কসোভো, ১৫. উত্তর সাইপ্রাস ও ১৬. বাংলাদেশ।

অস্পষ্ট রাষ্ট্র : যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথাও নেই, আবার রাষ্ট্রধর্মও নেই। সেগুলো হচ্ছে- ১. ইন্দোনেশিয়া, ২. সিয়েরালিওন, ৩. আলবেনিয়া ও ৪. লেবানন।

রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও মুসলিম দেশগুলো:
রাজনৈতিকভাবে মুসলিম দেশগুলোর সরকারব্যবস্থা একরকম নয়। কিছু দেশে রাজতন্ত্র¿ চালু রয়েছে, কিছু দেশে সামরিক বাহিনী প্রভাবিত একনায়কত্ব কায়েম আছে, আর কিছু দেশে নির্বাচিত সরকার চালু রয়েছে। আবার কিছু দেশ রাজনৈতিক সঙ্কটে নিপতিত। যেসব দেশে নির্বাচনব্যবস্থা চালু রয়েছে, সেখানেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত নেই, বরং চালু আছে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র।

রাজতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থা :
৯টি দেশে রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু রয়েছে : যথা- ১. সৌদি আরব, ২. কাতার, ৩. ওমান, ৪.ব্রুনাই, ৫. বাহরাইন, ৬. কুয়েত, ৭. আরব আমিরাত, ৮. জর্ডান ও ৯. মরক্কো।

অবশ্য সব রাজতান্ত্রিক দেশও এক রকম নয়। সৌদি আরবে কোনো নির্বাচিত পার্লামেন্ট/মজলিস নেই। মূলত বাদশাই সব রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করেন। কাতার, ওমান ও ব্রুনাইয়ে একটি আধা নির্বাচিত পার্লামেন্ট/ পরামর্শ পরিষদ থাকলেও সেখানে বংশানুক্রমিক আমির বা সুলতানই সব নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আরব আমিরাতেও একটি নির্বাচিত মজলিস/পার্লামেন্ট রয়েছে তবে বংশানুক্রমিক আমিরই সব নিয়ন্ত্রণ করেন। সাংবিধানিকভাবে জর্ডানে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র চালু রয়েছে। বাদশাহ হচ্ছেন রাষ্ট্রপ্রধান আর শাসনকর্তৃত্বও বাদশাহর হাতে। তবে প্রধানমন্ত্রী ও কেবিনেটের সাথে তার অংশীদারিত্ব রয়েছে, যদিও সংবিধান অনুযায়ী সরকারপ্রধান হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। জর্ডানের পার্লামেন্ট দ্বিকক্ষবিশিষ্ট। নিম্নকক্ষের সদস্যরা সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত হন, আর উচ্চকক্ষের সদস্যরা নিম্নকক্ষের অনুমোদনসাপেক্ষে বাদশাহ কর্তৃক মনোনীত। ১৯৯২ সালের পর থেকে সেখানে বহুদলীয় ব্যবস্থা চালু রয়েছে। অনেক দলই বাদশাহর অনুগত। মরক্কোতে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র চালু রয়েছে। ১৯৯৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী পার্লামেন্ট জনগণ দ্বারা নির্বাচিত। নতুন সংবিধান অনুযায়ী পরোক্ষভাবে নির্বাচিত একটি উপদেষ্টা পরিষদ রয়েছে, যার প্রকৃত উদ্দেশ্য বাদশাহর প্রাধান্যকে নিশ্চিত করা। বাদশাহ রাষ্ট্রের প্রধান এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদকে নিয়োগ দেন। পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা তার রয়েছে। মরক্কোতে চালু রয়েছে বহুদলীয় ব্যবস্থা।

সঙ্কটাপন্ন দেশ/ভঙ্গুর রাষ্ট্রগুলো :
বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের কমপক্ষে সাতটি দেশ রাজনৈতিক দিক দিয়ে সঙ্কটাপন্ন ও অস্থির। কিছু দেশে চলছে গৃহযুদ্ধ এবং জাতিগত-গোত্রীয় সঙ্ঘাত। কার্যত এগুলো কম-বেশি ভঙ্গুর রাষ্ট্র। সেগুলো হচ্ছে- সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেন। কিছু দেশে চলছে উগ্রপন্থীদের সামরিক-সন্ত্রাসী তৎপরতা। সেগুলো হচ্ছে- নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক ইত্যাদি।

মিসরে অবাধে ভোটে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে একটি সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পরে সে সামরিক জান্তার প্রধান প্রহসনের নির্বাচনের ব্যবস্থা করে প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। তবে মিসরে কার্যত সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠিত আছে। সেখানেও অস্থিরতা-সঙ্কট এবং মাঝে মধ্যে সঙ্ঘাত লক্ষ করা যাচ্ছে।

নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা :
বাকি মুসলিম দেশগুলোতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। কিছু দিন আগেও দেশগুলোর বেশির ভাগই সামরিক শাসিত দেশ ছিল, অনেক দেশে ছিল একদলীয় ব্যবস্থা। বর্তমানে অবশ্য সরাসরি সামরিক শাসন কোনো দেশে নেই। তবে বেশির ভাগ দেশে নির্বাচনব্যবস্থা অবাধ ও স্বচ্ছ নয়।

মোটকথা, মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোতে একই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু নেই। রাষ্ট্রের সাথে ইসলামের সম্পর্কও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইতিবাচক নয়।

তদুপরি, ধর্মীয় বিবেচনায়ও বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের মাজহাব ও ফেরকাভিত্তিক সমাজ রয়েছে। মুসলিম বিশ্বের পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনতে এ দেশগুলোতে ইসলামি ও নির্বাচিত সরকারব্যবস্থা প্রয়োজন। প্রয়োজন বিভিন্ন ফেরকার মধ্যে সমঝোতা ও সহনশীলতা। সাথে সাথে অবশ্যই প্রয়োজন প্রতিটি দেশে সুশাসন ও উন্নয়ন এবং বিজ্ঞান ও নৈতিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। সাথে সাথে ইসলামি শিক্ষা ও মূল্যবোধের প্রসার এবং বাস্তবায়নও প্রয়োজন। তাহলেই মুসলিম বিশ আবার জেগে ওঠার আশা করা যায়।

Comments

Popular posts from this blog

ঢাকার কোথায় কি পাওয়া যায়?

কোন শাক-সবজি ও ফলের কী ভিটামিন?

গবাদি পশুর রোগ ও তার প্রতিকার

কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা