আঙুর ফল টক
লেখা হতো যদি অন্য স্টাইলে
মাসুদ রানা স্টাইল:
গভীর রাত। শ্বাপদসংকুল জঙ্গল। সুন্দরবন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দুর্ধর্ষ স্পাই খেক্স শিয়াল বেরিয়েছে শিকারে। চোখে নাইট গগলস, ঠোঁটে ভুবন ভোলানো হাসি। তিন কিলোমিটার দূরের ঝিঁঝিপোকাটিকেও সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সাঁৎ করে একটা অশুভ ছায়া যেন সরে যায় পাশ থেকে। কোমরের বেল্টে গুঁজে রাখা ওয়ালথার পিপিকেটা হাত দিয়ে একবার ছুঁয়ে নেয় খেক্স। নাক আকাশের দিকে তুলে বাতাসের গতিবিধি বোঝার চেষ্টা করে সে। একটু এদিক-ওদিক হলেই শিকারি থেকে নিজেই শিকারে পরিণত হবে, খেক্স তা জানে। কাঁচা-পাকা ভ্রুর সেই মানুষের মুখটা এক ঝলকে খেক্সের সামনে ভেসে ওঠে। সাবধানবাণী তাঁর মুখে, ‘সাবধান! বন মুরগি শিকার পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজের একটা!
সাবধান, খেক্স! সাবধান!’
সাবধানি খেক্স এগিয়ে চলে। কিন্তু বাতাসে মাতাল করা এক ঘ্রাণ। শরীর মুহূর্তেই চনমনে হয়ে ওঠে। অন্ধকারের ভেতর একটা ঝোপের মধ্যে বাতাসে ডাইভ কাটতেই একটা ঝিলিক। মুহুর্মুহু মেঘের ডাক। আর সেই বৈদ্যুতিক ঝিলিকেই খেক্স প্রথম দেখে আঙুরের থোকাটা। অনিন্দ্যসুন্দর। প্রমাণ সাইজের গোল গোল আঙুরগুলো যেন তাকিয়ে আছে তারই দিকে। রবীন্দ্রনাথ মনে পড়ে যায় খেক্সের—আমি পাইলাম, ইহাকে পাইলাম!
মুহূর্তেই খেক্সের হাতে বেরিয়ে আসে ওয়ালথার পিপিকে। নিখুঁত নিশানায় ছুড়ে দেয় গুলি। মিস! এই প্রথম খেক্সের নিশানা এমন হলো। মনে মনে রেগে উঠলেও নিজেকে শান্ত রাখল সে। এ রকম পরিস্থিতিতে নিজেকে কীভাবে শান্ত রাখতে হয়, তার ট্রেনিং সে সেই শিক্ষানবিশকালেই নিয়েছে। দ্বিতীয় গুলিটা ছুড়ল সে। টার্গেট মিস। কোথাও একটা বনমোরগ ডেকে উঠল। যেন তাকে নিয়েই তামাশা করছে। তৃতীয় গুলি...মিস! চতুর্থ...মিস! একে একে ম্যাগাজিন খালি করে দিল খেক্স। কী হয়েছে আজ তার? সামান্য এক আঙুরের থোকাই সে গুলি করে ফেলতে পারছে না? বয়স হয়ে যাচ্ছে? এরপর কি তার জন্য শুধু অপেক্ষা করছে ডেস্কের চাকরি? মনে মনে প্রমাদ গুনল খেক্স। রাতের অখণ্ড নীরবতা খণ্ডন করে, নরক গুলজার করে একটানা দ্বিতীয় ম্যাগাজিনটাও শেষ করল সে। নাহ্! ফুরিয়ে গেছে সে! ঠিক তখনই তার মনে এল বাংলা প্রবাদটা—আঙুর ফল টক। ঠোঁটে ভুবন ভোলানো হাসিটা ফিরে এল খেক্সের। তাই তো, টক আঙুরের জন্য এত কিসের কষ্ট? খেক্স আঙুরের থোকা ছেড়ে একটা ডাইভ দিল সামনে। আশপাশেই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে বনমোরগের, যেটাকে শিকার করাই তার মিশন, টক আঙুর নয়!
হিমু সিরিজ স্টাইল
বইয়ের নাম: একজন হিমু শিয়াল ও এক থোকা আঙুর (চলতি মেলার বেস্টসেলার)
রাত বারোটা।
হলুদ পাঞ্জাবি পরে নিজের ডেরা থেকে বেরিয়ে এসেছে হিমু শিয়াল। রূপবতী শিয়ালকন্যা রুপার বাসায় আজ তার দাওয়াত। এই দাওয়াত রুপা দিয়েছিল তিন বছর আগে। বাংলা পঞ্জিকা মিলিয়ে দিন-তারিখ ঠিক করে দাওয়াত। কারণ, আজ কোনো সাধারণ দিন নয়। আজ পূর্ণিমা। এই পূর্ণিমাটাও সাধারণ কোনো পূর্ণিমা নয়; আজকের এই পূর্ণিমাতেই একদিন ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন সিদ্ধার্থ। আজ বেরিয়েছে হিমু শিয়াল।
আকাশ মেঘলা। চাঁদের দেখা নেই। টোটাল ব্ল্যাকআউট বন। মাঝে মাঝে দু-একটা জোনাক পোকা জ্বলতে জ্বলতে নিভে যাচ্ছে। বাবার উপদেশ মনে পড়ে হিমু শিয়ালের। উপদেশ ১৩৭-এ লেখা ছিল, ‘জোনাক পোকার দিকে তাকালে দেখিতে পাইবে সে ক্ষণকাল জ্বলিয়াই নিভিয়া যায়। মানুষ জোনাক পোকার মতোই ক্ষণে ক্ষণে জ্বলিয়া ওঠে ও নিভিয়া যাইতে থাকে। কিন্তু মহাপুরুষ জ্বলা ও নেভার বাইরের এক সত্তা। তুমি কখনো জ্বলিবেও না, কখনো নিভিবেও না!’
জোনাক পোকা দেখতে দেখতে হিমু শিয়াল কখন যে আঙুরগাছের নিচে এসে হাজির হয়েছে, বুঝতেও পারেনি। গাছের ওপর থোকা থোকা আঙুর। হিমু শিয়াল ভাবল, রুপার জন্য আঙুর নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। আগে মানুষ মৃত্যুপথযাত্রীদের দেখতে আঙুর নিত। বাড়িতে আঙুর দেখেই বোঝা যেত, এই বাড়িতে হয় কেউ মারা গেছে, না হয় মারা যাবে। আঙুর নিয়ে রুপার সামনে হাজির হলে সে নিশ্চয় ভ্রু কুঁচকে তাকাবে। তাকাক, হিমুরা পৃথিবীর সব কোঁচকানো ভ্রু উপেক্ষা করতে পারে।
হিমু শিয়াল গাছ ধরে ঝাঁকাল কয়েকবার। তার মনে হচ্ছে, যেকোনো সময়ই আঙুরের থোকাটা পড়ে যাবে। কিন্তু না, অনেকক্ষণ চেষ্টার পরেও আঙুর পড়ল না। ঠিক এ সময় আকাশের মেঘ কেটে গেল। গোল থলথলে চাঁদ আকাশে। হিমু শিয়াল চাঁদের দিকে তাকিয়ে বাবার উপদেশের কথা আবার মনে করল। কোনো কিছুতেই জ্বলা বা নেভা যাবে না। সে আঙুরের থোকার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। আঙুর ফল টক। এর জন্য নিজেকে জ্বালিয়ে বা নিভিয়ে লাভ কী! আর যখন আঙুরই পাওয়া গেল না, তখন রুপার বাড়িতে দাওয়াত খেতে গিয়েই বা কী লাভ? রুপা হয়তো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে...রুপাকে কি সে একবার বলে আসবে যে আঙুর ফল আসলে টক?
হিমু শিয়াল দ্বিধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বনের ভেতর। তার হলুদ পাঞ্জাবি আর ধূসর লেজ ভেসে যাচ্ছে গৃহত্যাগী জোছনায়।
বাংলা সিনেমা স্টাইল
সিনেমার নাম: আঙুর কেন টক! (সম্পূর্ণ রঙিন)
বনের সবচেয়ে বড়লোকের শিয়ালকন্যা শিলুকে ভালোবাসে দরিদ্র ফক্স খান। সিনেমার শুরুতেই শিলু আর ফক্স খানের হাত ধরাধরি করে বৃষ্টিতে ভিজে এক গান—চুরি করেছ আমার মনটা...হায় রে হায় শিয়ালকন্যা!
কিন্তু গান শেষ হতে না-হতেই শিলুর প্রতাপশালী পিতার গুন্ডারা এসে ধরে নিয়ে যায় ফক্স খানকে। শিলুর বাবার বিরাট বাড়ি। আর বাড়ির ভেতর প্রকাণ্ড সিঁড়ি। সেই সিঁড়ির নিচে শিলুর বাবা ও ফক্স খানের কথোপকথন
: তোর এত বড় সাহস, তুই আমার মেয়ের লেজের দিকে তাকাস!
: চৌধুরী সাহেব, শুধু লেজ না, আমি আপনার মেয়ের চোখ-কান-মাথা-নখ—সব ভালোবাসি!
: চোপ! তুই জানিস, আমি কে? আমার মেয়ে সারা দিনে যত গিগার ইউটিউব ইউজ করে, তুই তত গিগা চোখেও দেখিস না!
: একটা কথা জেনে রাখবেন চৌধুরী সাহেব, হতে পারি আমি গরিব, হতে পারে আমি ফ্রি ফেসবুক চালাই, কিন্তু আমারও মান-সম্মান আছে! আপনার মেয়ে হয়তো আমার কাছে গিগাবাইট পাবে না, কিন্তু ভালোবাসা পাবে!
: ভালোবাসা! হুহ্! যদি তুই সত্যি আমার মেয়েকে ভালোবাসিস, তাহলে আজই বনের সবচেয়ে উঁচু জায়গাটা থেকে পাকা আঙুরের থোকাটা পেড়ে এনে দেখা! যদি না পারিস, তাহলে ভুলে যা আমার মেয়েকে!
ভালোবাসা জয় করতে দরিদ্র ফক্স খান ছুটল আঙুর পাড়তে। কিন্তু আঙুরের থোকাটা যে অনেক উঁচুতে। ফক্স খান নায়ক রুবেলের মতো লাফ দিয়ে গাছে ওঠার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যর্থ হলো সে। তারপর বনের রাজা টারজান ড্যানি সিডাকের মতো প্রবল ঘুষি চালাল গাছে, তাতে লতানো গাছটা কিছুটা নড়ল বটে, কিন্তু আঙুর পড়ল না। অবশেষে সে ট্র্যাজিক কিং জসিমের মতো হু হু করে কেঁদে উঠল গাছতলায়। কিন্তু না, এতেও মন গলল না আঙুর থোকার। তখন সে আঙুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আসলে আঙুর ফল আর বড়লোকের মেয়ে—দুটোই টক!’ বলেই সে চলে গেল সিনেমার সেকেন্ড নায়িকার কাছে!
রাবীন্দ্রিক স্টাইল
বইয়ের নাম: শেষের আঙুর (সুলভ সংস্করণ)
খবর শুনিয়া শৃগাল সবুর করিতে পারিত, কিন্তু তাহার মন আর গৃহে টিকিল না। ইহাও কি সম্ভব? তাহারই বাটির সমুখে, তাহারই চোখের আড়ে, এত বড় এক আঙুরগাছ বাড়িয়া উঠিয়াছে, অথচ তাহার হদিস তাহার জানা নাই?
শৃগাল ঊর্ধ্বমুখে ছুটিল। পাশের গর্তের লাল লেজুরের শৃগাল জানিবার আগেই আঙুর গাছখানা তাহাকে আবিষ্কার করিতে হইবে। ইহা যত না আপনার লোভের জন্য, তাহার চাইতেও বেশি আসলে ইংরাজি ইগোর কারণে। ইংরাজ জাতের আর কিছু গ্রহণ না করিলেও আমাদের শৃগাল তাহাদের ইগোখানা সযত্নেই গ্রহণ করিয়াছিলেন।
খুঁজিয়া-ফিরিয়া শৃগাল কাঙ্ক্ষিত আঙুরগাছখানি আবিষ্কার করিল বটে। এক আশ্চর্য গাছ! ঊর্ধ্বমুখে বিস্তৃত হইয়া গগন ছুঁইবার অভিপ্রায়ে উঠিতেই আছে উপরের দিকে। শৃগাল গাছের একেবারে মাথায় আঙুরের থোকাখানিকে লক্ষ্য করিল। আহা, কী অপরূপ শোভা! যেন বা এক্ষণেই তাহার পাকস্থলীতে যাইবার উপযুক্ত। যেন ইহাই তাহার সম্পদ, ইহাই তাহার সম্পত্তি!
শৃগাল কসরত কম করিল না! প্রথমে মাটির ঢেলা কুড়াইয়া আঙুরের থোকার দিকে মারিতে লাগিল। হা ভগবান, তাহার কোনোটাই গিয়া আঙুরথোকাখানিকে স্পর্শ পর্যন্ত করিল না। ইহার পরে শৃগাল আরো ক্রুদ্ধ হইয়া গাছে উঠিবার প্রত্যয় প্রকাশ করিল। কিন্তু সেই আশারও যে গুড়ে বালি! শৃগাল কতকবার পড়িতে পড়িতে বাঁচিল, কতকবার মরিতে মরিতে বাঁচিল!
কিন্তু শেষরক্ষা আর হইল না! গাছে উঠিতে গিয়া এইবার সে পিছলাইয়া একেবারে মনসা কাঁটায় গিয়া পড়িল। ‘মাগো!’ বলিয়া এক আর্তচিৎকার বাহির হইয়া আসিল তাহার কণ্ঠ হইতে। কাঁটা হইতে নিজেকে উঠাইয়া সে আঙুর থোকার দিকে চাহিয়া বলিল, ‘আঙুর ফল তো টক!’ এই টক আঙুর যদি বা ওই লাল লেজুরের শৃগাল খায় তো খাক, তাহার কী যায়-আসে!
শৃগাল ফিরিয়া চলিল। মাথায় তাহার ঘুরিতেই থাকিল—আঙুর ফল টক! আঙুর ফল টক!
Comments
Post a Comment