Skip to main content

কারুন ও তার অভিশপ্ত ধন


কোরআনের ভাষায়:‘অতঃপর কারূন জাঁকজমক সহকারে তার সম্প্রদায়ের সামনে বের হল। যারা পার্থিব জীবন কামনা করত, তারা বলল, আহা! কারূনকে যেরূপ দেয়া হয়েছে আমাদেরকেও যদি তা দেয়া হত। নিশ্চয়ই সে বড় ভাগ্যবান। (সূরা কাসাস, ৭৯)



বর্ণনা-১
ধনগর্বী কারুনের পতনকথা
- মাওলানা আবদুস সবুর

'অতঃপর আমি কারুন ও তার প্রাসাদকে মাটিতে দাবিয়ে দিলাম। তখন তার জন্য এমন কোনো দল ছিল না, যে আল্লাহর মোকাবিলায় তাকে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও নিজেকে সাহায্য করতে সক্ষম ছিল না।'

(সূরা কাসাস : ৮১)মুসা (আ.) বনি ইসরাইলের একজন প্রভাবশালী নবী ছিলেন। তার মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের গোলামি থেকে মুক্ত করেছিলেন। কারুন নামে মুসা (আ.) এর একজন চাচাতো ভাই ছিল। প্রকাশ্যে মুসা (আ.) এর ওপর ঈমান রাখত; কিন্তু ভেতরে সে ছিল মোনাফেক। কারুনকে আল্লাহ তায়ালা প্রচুর সম্পদ দিয়েছিলেন।

বর্ণিত আছে, কারুনের সম্পদ রাখার গুদামঘরের চাবিগুলো আনা-নেয়ার জন্য ৬০টি খচ্চর ছিল। (তাফসিরে ইবনে আবি হাতেম : ১১/৩৪৮; হাদিস : ১৭৮৩৭)।

মুসা (আ.) এর মোমিন কওম কারুনকে চারটি নসিহত করেছিল।

এক. আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'স্মরণ করো, যখন তার কওম তাকে বলল, দম্ভ করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিকদের ভালোবাসেন না'। (কাসাস : ৭৬)।

দুই. 'আর আল্লাহ তোমাকে যা দান করেছেন, তাতে তুমি আখেরাতের নিবাস অনুসন্ধান করো। তবে তুমি দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলে যেও না।' (কাসাস : ৭৭)।

তিন. 'হে কারুন শোনো! তোমার প্রতি আল্লাহ যেরূপ অনুগ্রহ করেছেন, তুমিও মানুষের প্রতি সেরূপ অনুগ্রহ করো।' (কাসাস : ৭৭)।

চার. 'আর জমিনে ফ্যাসাদ করতে চেও না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ফ্যাসাদকারীদের ভালোবাসেন না।' (কাসাস : ৭৭)।
টাকার গরমে পৃথিবীতে ফ্যাসাদ হয়, টাকার গরমেই যত অনিষ্ট হয়। যাদের টাকা আছে তারা বলে ধর-মার। যত টাকা লাগে দেব, তবুও এই কাজটি হতে হবে ইত্যাদি।

কারুনের জবাব:
কিন্তু কারুন কী জবাব দিয়েছিল তাদের? আল্লাহ তায়ালা হুবহু কারুনের জবাব উল্লেখ করে দিয়েছেন। সে বলেছিল, 'আমি তো এই ধনভাণ্ডারপ্রাপ্ত হয়েছি আমার কাছে থাকা জ্ঞান দ্বারা।' (কাসাস : ৭৮)। অথচ সে চিন্তা করে দেখল না যে, টাকা কামাই করার জন্য বুদ্ধি লাগে ঠিক। কিন্তু কত বুদ্ধিওয়ালা, কত বড় বড় ডিগ্রিধারী আছে, যারা ভাত পায় না। আর একজন সাধারণ মূর্খ মানুষ, সে কোটি কোটি টাকার মালিক, টাকা গুনে শেষ করতে পারে না।

কারুনের পরিণতি:
আল্লাহ তায়ালা বলেন, 'সে কি জানত না যে, আল্লাহ তার আগে বহু প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। যারা ছিল তার থেকে শক্তিমত্তায় প্রবলতর এবং জনসংখ্যায় অধিক। আর অপরাধীদের তাদের অপরাধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে না।' (কাসাস :৭৮)।

হজরত মুসা (আ.) একদিন তার মোমিন উম্মতকে ওয়াজ-নসিহত করছিলেন। এ সময় কারুন তার টাকা-পয়সা ও ধনদৌলতের গরম দেখিয়ে, তার বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে, গাড়ি আর উট সাজিয়ে, তার ওপর সাওয়ার হয়ে, খুব ধুমধামের সঙ্গে হজরত মুসা (আ) এর সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। আল্লাহ তায়ালা হুবহু বর্ণনা তুলে দিয়েছেন, 'অতঃপর সে তার কওমের সামনে জাঁকজমকের সঙ্গে বের হলো। যারা দুনিয়ার জীবন চাইত তারা বলল, আহা! কারুনকে যেমন দেয়া হয়েছে, আমাদেরও যদি তেমন থাকত! নিশ্চয় সে বিরাট সম্পদশালী।' (কাসাস : ৭৯)।

মুসা (আ.) এর কাছে বুঝদার কিছু লোক ছিল। তারা বলল, শোন! তোমরা এসব মালের লোভ করো না। এর মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। বরং এর মধ্যে খারাবি আছে। জ্ঞানপ্রাপ্ত এসব ব্যক্তির উক্তি আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করেছেন, 'আর যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছিল, তারা বলল, ধিক তোমাদের! আল্লাহর প্রতিদানই উত্তম, যে ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে তার জন্য। আর তা শুধু সবরকারীরাই পেতে পারে।' (কাসাস : ৮০)।

এ কথা আলোচনা করতে করতেই দেখা গেল, আল্লাহর পক্ষ থেকে আজাব এসে কারুনকে তার সব সম্পদ ও সৈন্য-সামন্তসহ ধসিয়ে দিল। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, 'অতঃপর আমি কারুন ও তার প্রাসাদকে মাটিতে দাবিয়ে দিলাম। তখন তার জন্য এমন কোনো দল ছিল না, যে আল্লাহর মোকাবিলায় তাকে সাহায্য করতে পারত এবং সে নিজেও নিজেকে সাহায্য করতে সক্ষম ছিল না।' (কাসাস : ৮১)।

কারুনকে চারটা নসিহত করা হয়েছিল। কিন্তু সে মানেনি। সম্পদের গরম দেখিয়েছে, হক আদায় করেনি, কাউকে কিছু দেয়নি।

উল্টো নিজের বুদ্ধির বাহাদুরি দেখিয়েছে। ফল কী হয়েছে? আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছে। আজাব এসে তার সব কিছু মাটিতে দাবিয়ে দিয়েছে। কোনো কোনো মুফাসসির বলেন, সে কেয়ামত পর্যন্ত মাটির নিচে যেতেই থাকবে। কত বড় ও কঠিন শাস্তি তাকে দেয়া হয়েছে। ওই চারটি নসিহত আল্লাহ তায়ালা আমাদের জন্য পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করে দিয়েছেন, যেন আমরা সতর্ক হতে পারি, নসিহত গ্রহণ করতে পারি।

বর্ণনা-২

কারুন ও তার অভিশপ্ত ধন

আজ থেকে অনেক দিন আগের কথা। তখন মিশরে বনী ইসরাঈল নামে এক জাতি বাস করতো। তাদের মধ্যে কাসাস নামে এক লোক ছিল। তার ছিল দুই টি ছেলে, একজনের নাম বাশার এবং অপর ছেলের নাম ইমরান। ইমরানের ছিল আবার দুই পুত্র। এক পুত্রের নাম মুসা এবং অপর জনের নাম হারুন।

অপরদিকে বাশারের ছিল একটি মাত্র ছেলে, তার নাম কারুন। হযরত মুসা (আঃ) এই কারুন কেই আদর করে লেখাপড়া শিখিয়েছিলেন। তাঁর দোয়ায় কারুন এক কালে মিশরের শ্রেষ্ঠ ধনী হয়েছিল। 
মহান আল্লাহ তা'আলা তাকে দয়া করে সোনা-দানা, মনি-মুক্তা,হীরা-জহরত আর উট-গাধা, ঘোড়া সহ অঢেল সম্পদ দান করেছিলেন। আজ পর্যন্ত আল্লাহ তা'আলা সম্ভবতঃ এত ধন-সম্পদ আর কোন মানুষকে দেননি। আল্লাহ পাক কারুনকে কত যে ধনরত্ন আর সম্পদ দান করেছিলেন, তার হিসেব নেই। শুধু একথা জানা গেল, তার ধন-দৌলত রাখবার এতো ঘর আর সিন্দুক ছিল যে, চল্লিশটি উট লাগত সেসব ঘরের চাবি বহন করতে। এ থেকেই অনুমান করা যায় যে, তার ধন-সম্পদের পরিমান কত হতে পারে। এত বিশাল সম্পত্তি পাওয়ার পরও কিন্তু কারুন এতই কৃপণ ছিল যে, সমস্ত ধন-সম্পদ সে কেবল তার তোষাখানায় জমা রাখতো। ভূলেও কোনদিন তার একটি পয়সাও সৎ কাজে ব্যয় করত না।
ফকির-মিসকিনদের দান খয়রাত করতো না। আল্লাহ তা'আলার দেয়া অগণিত ধন-সম্পদের মালিক হয়ে কারুন আল্লাহকে ভুলে গিয়ে ছিল। কারুনকে তার ধন-দৌলত সৎ কাজে ব্যয় করার পরামর্শ দেয়া এবং তাকে দ্বীনের দিকে আহবান করার জন্য আল্লাহ পাক হযরত মুসা (আঃ)-কে পাঠান। মহান আল্লাহ তা'আলার হুকুমে হযরত মুসা (আঃ)কারুন কে বললেন- "হে কারুন! তুমি তোমার জমানো ধন-রত্ন ও মাল-সম্পদের যাকাত প্রদান কর। না হলে আল্লাহ পাক নারাজ হবেন।" কারুন ভাল মানুষটির মত জবাব দিল- বেশ তো। যাকাত কত দিতে হবে আগামী কাল তুমি তার একটা হিসেব দিও। হযরত মুসা (আঃ) পরদিন কারুনের শুধু উট, গাধা, ঘোড়া বকরী প্রভূতি পশুর হিসেব নেন। হিসেব করে দেখা যায় -যাকাতে পশুর সংখ্যা দাঁড়াবে কয়েক লক্ষ। হযরত মুসা (আঃ) যখন শুধু পশু সম্পদের যাকাতের হিসেব দিলেন, তাতেই কানজুস কারুনের মাথা বিগড়ে গেল। সে ভাবল- এত বিরাট অংশ যাকাত দিতে হবে? না , তা হয় না। তাই সে মতলব এঁটে ছলচাতুরীর আশ্রয় গ্রহণ করে বলল, - মুসা! আমি তোমার বদ মতলব বুঝতে পারছি। যাকাতের নামে আমার ধন-রত্ন নিয়ে তুমি মালদার হতে চাও? সেটি হচ্ছে না। আমি এত বোকা নই যে, সাধ করে নিজের ধন-সম্পদ তোমাকে বিলিয়ে দেব। সুতরাং আমার মালামাল ঘরেই পঁচে যাক, তবও যাকাত দিবো না। কারুনের কথা শুনে হযরত মুসা (আঃ) বললে,- "তোমার ধন-সম্পদের প্রতি আমার কোন লোভ নেই। তুমি আমাকে মিথ্যা সন্দেহ করছ। যাকাত ধর্মের একটি অংশ। মালের যাকাত দেয়া আল্লাহর হুকুম। আল্লাহ তোমাকে বেশুমার ধন-দৌলতের মালিক করেছেন। আমার কথা শোন। যাকাতের বিধান পালন করে সম্পদের কিছু অংশ আল্লাহর পথে ব্যয় কর।"

কৃপণ কারুন জবাবে বলল -"আল্লাহর ভয় যখন দেখাচ্ছ, তখন মালের কিছ যাকাত দিতে পারি এক শর্তে।"
হযরত মুসা (আঃ) বললেন,- "বলো কি তোমার শর্ত?"

কারুন বলল,- আল্লাহ তোমাকে পয়গাম্বরী দান করেছেন। আর তুমি তোমার ভাই হারুনকে খিলাফত দিয়েছ। হারুনের মত আমাকেও যদি খেলাফত দাও, তাহলে আমি তোমার কথামত যাকাত দেব। হযরত মুসা (আঃ) বললেন, -"দেখ কারুন! তুমি ভুল বুঝেছ। খিলাফত বা নবুওয়াত দানের ক্ষমতা আমার নেই।আল্লাহ তাআলা যখন যাকে নবুওয়াত দেয়ার ইচ্ছা করেন, তখন তিনিই সেই গুণের অধিকারী হতে পারেন। এতে মানুষের কোন হাত নেই। কারুন! আল্লাহ তোমাকে এ দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ধনী করেছেন। তুমি তোমার মালের যাকাত দাও। তাতে তুমার সম্পদ তোমার জন্য হালাল হবে এবং সম্পদে বরকত হবে। তুমিও নাজাত পাবে।"

কারুন বলল,- মুসা! আল্লাহ যদি আমাকে খিলাফত না দেন, তবে তিনি কেন আমার কাছে যাকাত দাবী করবেন? আমি নিজের ক্ষমতা , যোগ্যতা ও কৌশলর জোরে এসব ধন-সম্পদ রোজগার করেছি। এত আল্লাহর হক কিভাবে হল? আর তুমিই বা আমাকে কেন যাকাত দিতে বলছ? এই বলে বখীল কারুন রাগ করে হযরত মুসা (আঃ)-এর সামনে থেকে সরে গেল।
পরদিন কারুন তার সঙ্গীদের কে ডেকে বলল,- দেখ, মুসার জন্য এখন আমাদের ধন-দৌলত রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। সে বলে কিনা মালদাররা মালের যাকাত না দিলে আল্লাহ নারাজ হবেন।

সঙ্গীদের একজন বলল- গায়ে খেটে কষ্ট করে টাকা-পয়সা রোজগার করব, আবার তার থেকে বছর বছর যাকাত দিতে হবে! মুসা পয়গাম্বরী পেয়ে যতসব ঝামেলা শুরু করেছে। 
কারুন বলল, সত্যি বলতে কি জান? মুসা যাকাতের নাম করে আমাদের ধনে বড়লোক হতে চায়। একথা শুনে সঙ্গীরা বলে উঠে- ঠিক ঠিক। মুসার মতলব ভাল নয়। এর একটা বিহিত করতেই হবে। সঙ্গীদের একজন বলল- আমিও তাই বলতে চেয়েছিলাম।মুসার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। আল্লাহর নবী বলে তাকে আর আশকারা দেওয়া ঠিক নয়। আমার মতে মুসাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলাই উচিৎ। 
অন্যজন বলল- আমার মতে, খুন-খারাবীর দরকার নেই। এসব ঝামেলা করতে গেলে বিপদও হতে পারে। তার চেয়ে জন সমাজে তাকে এমন ভাবে জব্দ করতে হবে, যাতে সে লজ্জিত হয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায়।
দ্বিতীয় সঙ্গীর কথা শুনে কারুন বলল- তোমার পরামর্শটা মন্দ নয়। এখন তুমিই এর একটা ব্যবস্থা করবে- কিভাবে মুসা কে জব্দ করা যায় এবং চাপে পড়ে এদেশ ছেড়ে যেন অন্যত্র চলে যায়।


কারুনের হুকুম পেয়ে সঙ্গীটি একটি অসৎ চরিত্রের মেয়েকে লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে এল। তাকে গা ভরা শাড়ী গয়না ও এক থলে টাকা দিয়ে বলল, "ধনপতি কারুনের জন্য তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। মুসা যখন সভায় ওয়াজ-নসীহত করতে উঠবে, তখন আমরা তাকে চরিত্রহীন বলে ঠাট্টা করব। সে সময় তুমি বলবে- হ্যাঁ, একথা সত্য। আমাকে বিয়ে করবে বলে একদিন সে আমার হাত ধরেছিল। ব্যস, শুধু এতটুকু বললেই কাজ সমাধা হয়ে যাবে। এর জন্য দরকার হলে তুমি আরো টাকা পাবে।
মেয়েটি চুপ করে রইল। তারঃপর অনেক বলে কয়ে রাজী করালো।
এদিকে কারুন ভাবল-মেয়েটি যদি প্রকাশ্যে মুসার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে , তাহলে সেই অপরাধের জন্য সমাজ তাকে ঘৃণা বরে পরিত্যাগ করবে। আর এর জন্য ক্ষোভে মুসা এদেশ ছেড়ে চলে যাবে। তখন আমাদের উদ্দেশ্যে সফল হবে।


তারপর বিকালে ওয়াজ-নসীহতের সভা বসল। দলে দলে লোকজন এল হযরত মুসা (আঃ)-এর ওয়াজ-নসীহত শোনার জন্য জন্য। জামিল কারুনও তার দলবল নিয়ে এল। সভাস্থল কানায় কানায় ভরে গেল। হযরত মুসা (আঃ) ওয়াজ করার জন্য মঞ্চে উঠলেন। তিনি ওয়াজ শুরু করতে যাবেন, ঠিক এমন সময় পূর্ব পরিকল্পনা মত মিথ্যাবাদী কারুনের লোকজন বলে উঠল- হে মুসা! তুমি চরিত্রহীন। উপস্থিত জনতা কে তারা বলল- আমাদের কথা বিশ্বাস না হয়, এই মেয়ে লোকটিকে জিজ্ঞেস করুন। এই বলে কারুন মেয়ে লোকটিকে দাঁড় করিয়ে দিল। 
একথা শুনে লোকজন তাজ্জব হয়ে গেল। মুসা (আঃ) চরিত্র হীন, এটা কি বিশ্বাস যোগ্য কথা? এ বিষয়টি নিয়ে সভাস্থলে নানা গুঞ্জনের শুরু হয়ে গেল। সবাই মেয়েটির কথা শুনার জন্য তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রইল। হযরত মুসা (আঃ) মেয়েলোকটিকে বললেন, - "আমার বিরুদ্ধে কি নালিশ আছে- বলো! তবে যা বলবে , আল্লাহকে ভয় করে বলবে। মনে রেখ আল্লাহ সবকিছু দেখেন এবং শুনেন।"
হযরত মুসা (আঃ)-এর কথায় মেয়েটির অন্তর কেঁপে উঠল। ফলে কারুন তাকে যে কথা শিখিয়ে দিয়েছিল, আল্লাহ পাকের ভয়ে সে তা ভুলে গেল এবং তার মুখ দিয়ে আল্লাহর কুদরতে একথা বের হল- "ভাইসব! আপনারা মন দিয়ে শুনুন, ধনপতি কারুন আমাকে লোভ দেখিয়ে নবী মুসা (আঃ)-এর বিরুদ্ধে কৎসিত কথা বলতে বলেছিল।" একথা বলে মেয়েটি কারুনের দেয়া গয়নাগাটি ও পোশাকাদি সব খুলে ফেলে সভা থেকে চলে গেল। 
হযরত মুসা (আঃ) কারুনের এহেন জঘন্য ষড়যন্ত্রে ভীষন ভাবে দুঃখ পেলেন। আল্লাহ পাক তাঁকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করায় তিনি দয়াময়ের উদ্দেশ্যে সিজদা করলেন , অতঃপর দু'রাকাআ'ত শুকরিয়া নামায আদায় করেন। এরপর আল্লাহর দরবারে করজোড়ে ফরিয়াদ জানালেন-"হে পরওয়ার দেগার! জালিম ধনপতি কারুন থেকে আমাদেরকে রক্ষা কর। এই পাপী দুনিয়ার ধন-সম্পদের মোহে পড়ে আপনার উপর ঈমান হারিয়েছে। আপনার হুকুম -আহকাম সে মানে না। তার খপপরে পড়ে রাজ্যের অন্যরাও বেদ্বীন ও বেঈমান হয়ে যাচ্ছে। তাই আমার একান্ত ফরিয়াদ-পাপাত্মা কারুন থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন।"

দয়ময় আল্লাহ তাঁর প্রিয় পয়গাম্বরের আরজ মঞ্জুর করে ফেরেশতা জিব্রাঈলকে হযরত মুসা (আঃ)-এর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। জিব্রাঈল হযরত মুসা (আঃ)-কে বললেন, হে আল্লাহুর নবী ! আল্লাহ পাক আপনার আরজ মঞ্জুর করেছেন। এই যমীন কারুনকে ধ্বংস করার হুকুম পালন করবে। জিব্রাঈলের মুখে আল্লাহর বাণী শুনে মুসা (আঃ) তাঁর কওমের লোকদের ডেকে বললেন, -"তোমরা শোন, আল্লাহ পাক জামিল ফেরাউণ কে যে ভাবে ধ্বংস করেছেন। পাপী কারুনকেও সেই ভাবে ধ্বংস করবেন। সুতরাং বনী ইসরাঈলের মধ্যে যারা আমার অনুসারী, তারা বেদ্বীন কারুনের দল থেকে ফিরে আসবে।"হযরত মুসা (আঃ)-এর অনুসারীরা তাঁর কথা মত বেদ্বীনের সংগ ত্যাগ করল। এর পর হযরত মুসা (আঃ)-এর আরজীতে আল্লাহু তাআলার হুকুমে যমীন কারুনের হাঁটু পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলল। তখন কারুন ব্যাপারটিকে নিছক রসিকতা ভেবে হেসে ফেলল এবং বলল- হে মুসা! এটাতো দেখছি তোমার নতুন যাদু। এ যাদু তোমাকে কে শিখিয়েছে?
হযরত মুসা (আঃ) তার কথার কোন জবাব দিলেন না। অতঃপর তাঁর আরজীতে আল্লাহুর হুকুমে যমীন এবার কারুনের জানু থেকে কোমর পর্যন্ত গ্রাস করল। কারন তখন নিজের বিপদ বুঝতে পারল। ব্যাপারটা খেলা নয় ভেবে, সে সুর পাল্টে বলল-মুসা! তুমি কি ঠাট্টা বুঝ না।তোমার যাদুর খেলা বন্ধ কর। এখন থেকে আমি তোমার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবো। 
হযরত মুসা (আঃ) এবারও তার কথার কোন জবাব দিলেন না। আল্লাহুর হুকুমে পাপের প্রায়শ্চিত তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে। অতঃপর হযরত মুসা (আঃ)-এর আরজীতে আল্লাহুর হুকুমে যমীন কারুনের বুক পর্যন্ত গ্রাস করল। নাদান কারুন এত দিনে তার ভুল বুঝতে পারল। সে বুঝল মুসা সত্যি, আল্লাহুর নবী। তাঁর নসীহত না শুনে সত্যি সে অনেক বড় ভুল করেছে। মরণ যন্ত্রনায় সে চিৎকার করে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে কারুন বলতে লাগল, ভাই মুসা! আমার অপরাধ ক্ষমা করো। আমি না বুঝে তোমার উপর যুলুম করেছি। আমার ধন-দৌলত সব তুমি নাও। শুধু আমাকে প্রাণে বাঁচাও। কিন্তু কাঁদলে কি হবে, সময় ফুরিয়ে আল্লাহর হুকুম যখন এসে যায়, তখন আর কোন সুযোগ থাকে না। আর তাই কারুনের সকল অনুনয়-বিনয়, শত ক্রন্দন সবই বিফলে গেল। কারুনের সঙ্গী-সাথীরা এসব কান্ড দেখে হা করে চেয়ে রইল। কেউ তাকে রক্ষা করতে পারল না। দেখতে দেখতে আল্লাহুর হুকুমে যমীন কারুনকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল। আর এভাবেই জালিম কারুন ধ্বংস হল।

তার মৃত্যুর পর বেদ্বীনরা বলতে লাগল,-ইচ্ছে করলে, নবী মুসা (আঃ) কারুনকে বাঁচাতে পারতেন। আসলে কারুনের ধন-দৌলতের লোভেই তিনি তা করেন নি। লোকমুখে একথা প্রচার হলে, হযরত মুসা (আঃ) খুবই দুঃখ পেলেন। তিনি এই অপবাদ থেকে রেহাই পাবার জন্য মহান আল্লাহুর দরবারে প্রার্থনা করলেন,-"হে আমার মাবুদ। কারুন যখন নিপাত করেছেন, তখন তার বাড়ি-ঘর,দালান-কোঠা, ধন-রত্ন, সবকিছু ধ্বংস করে দিন। তা না হলে বেদ্বীনরা আমাকে নানা অপবাদ দিবে।" আল্লাহু রাব্বুল আলামিন সঙ্গে সঙ্গে হযরত মুসা (আঃ)-এর আরজ মঞ্জুর করে কারুনের দালান-কোঠা, ধন-রত্ন, সবকিছু মাটিতে দাবিয়ে গায়েব করে দিলেন।
কারুনের ঘটনাটি আমাদের মনে কি এত টুকু আঁচড় কাটবে না? উপরোক্ত ঘটনা থেকে স্পষ্ট ভাবে প্রতিয়মান হয় যে, লোভ, অহংকার, অন্যের হক ভোগ করা, কারো জন্যই কখনোই সুফল বয়ে আনবে না। কারুনের মত ধন-সম্পদ আমাদের না থাকলেও , অনেক বিত্তশালী আছেন আমাদের সমাজে, আছেন মধ্যবিত্তশালী সহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। যাঁরা এ লেখাটি পড়বেন, তাদের নিকট আমার সবিনয়ে আহবান থাকবে, খুবই অল্প সময় নিয়ে আমরা এ ধরার বুকে আগমন করেছি। পরকালের কিছু পাথেয় সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সময় শেষ হয়ে যাওয়ার আগেই একবার হলেও ভেবে দেখুন , আমাদের মধ্যে কি কারুনের জালিম চরিত্র আছে? যদি উত্তর হাঁ হয়, তাহলে কাল বিলম্ব না করে , এক্ষুনি মহান মাবুদের দরবারে ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করুন। তিনি যদি ক্ষমা না করেন, তাহলে আমাদের কারোর কোন নিস্তার নেই। যে যত কথাই বলি না কেন, জীবনের সকল কর্মের জবাবদিহির জন্য তাঁর দরবারে সবাইকে দাঁড়াতেই হবে। আর সেখানে উত্তীর্ণ হতে পারলেই জীবনের স্বার্থকতা। কারুন ও যদি মহান আল্লাহু তাআলার দরবারে ক্ষমা প্রার্থনা করতো, হয়তো আল্লাহু তাআলা দয়া করে ক্ষমা করে দিতেন। আসুন আমরা সবাই কারুনের জীবন কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়ে সংশোধন করি নিজেদের জীবন ধারা। আল্লাহু নিশ্চয়ই ক্ষমাশীল। আমিন।

- সংগৃহীত
-কোরাণের গল্প, বন্দে আলী মিয়া
-বাংলা ইসলামিক কার্টুন-কারুন ও তার অভিশপ্ত ধন।

Comments

Popular posts from this blog

ঢাকার কোথায় কি পাওয়া যায়?

কোন শাক-সবজি ও ফলের কী ভিটামিন?

গবাদি পশুর রোগ ও তার প্রতিকার

কৃষি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ

মুসলিম জীবনের আদব-কায়দা