আজকে সারা পৃথিবী বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত। বিজ্ঞানের ছায়ায় স্বস্তির সহজ জীবন আমাদের এই ছোট্ট পৃথিবীতে। কিন্তু এই বিজ্ঞান কথা বলতে কাদের দিকে দৃষ্ট্রি রাখে। এই বিজ্ঞান পথ চলতে কাদের কথা স্মরণ করে। মনে হয় তারা আজ পৃথিবীর সবচেয়ে অবহেলিত জাতি। চলুন সে অবহেলিত জাতির কথা কেন পরতে পরতে স্বীকার করে বিজ্ঞান.... জেনে নিই-
বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই ছিল মুসলমানদের অনেক অবদান। বিশেষত বিজ্ঞানের তিনটি বিষয়ে মুসলমানদের ছিল সবচেয়ে বেশি অবদান। মুসলমান বিজ্ঞানীরা মনে করতেন ইসলাম পরিপূর্ণভাবে পালন করার জন্য এ তিনটি শাখার উপর জ্ঞ্যান অর্জন করা আবশ্যক। এ তিনটি শাখা হচ্ছে প্রথম- মহাকাশ বিজ্ঞান, দ্বিতীয়- গণিত, তৃতীয়- চিকিৎসা বিজ্ঞান।
মহাকাশ বিজ্ঞান প্রয়োজন- চাঁদ এবং সূর্যের হিসাব নিকাশ বুঝতে। যেহেতু চাঁদের হিসাবটা বিশেষ বিশেষ দিন এবং বিশেষ বিশেষ মাস বের করা প্রয়োজন। আর সূর্যের হিসাবটা নামাযের ওয়াক্ত এবং অন্যান্য বিশেষ ওয়াক্ত বের করার জন্য প্রয়োজন।
আর গণিতটা প্রয়োজন- গণিত ছাড়াতো মহাকাশ বিজ্ঞান চিন্তাই করা যায়না। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য করাও সুন্নত। ব্যবসা-বাণিজ্যর জন্য হিসাব করতে গণিত লাগে। আবার ফারায়েজের মাসয়ালা অর্থাৎ সম্পত্তি বন্টনের জন্যও গণিত প্রয়োজন। আবার মহান আল্লাহ পাক কুরআন শরীফ-এ ইরশাদ করেন, “নামায শেষ হওয়ার পর তোমরা জমিনে ছড়িয়ে পর।” কোথাও যেতে হলে ম্যাপের দরকার। ম্যাপটা হলো ভূগোলের অংশ আর ভূগোলটা জ্যামিতির অংশ, জ্যামিতিও ওই গণিতের অংশ। ঐ আবার গিয়ে গণিতই লাগে।
আর চিকিৎসা বিজ্ঞানটা প্রয়োজন, কারণ চিকিৎসা করা সুন্নত। সুতরাং এ সুন্নত পালনের জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানের চর্চা করার প্রয়োজন। যদি চিকিৎসা বিজ্ঞান চর্চা না করা হয় তাহলে চিকিৎসার সুন্নতটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর একটা সুন্নতকে বিলুপ্ত করার মতো কবীরা গুণাহতো আর কিছু হতে পারেনা। এছাড়াও জান বাঁচানোতো ফরয। সূতরাং সে ফরয আদায়ের জন্যও তো চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
এছাড়াও মহাকাশ বিজ্ঞান যেহেতু পদার্থ বিজ্ঞানের একটি অংশ সেহেতু মুসলমানরা মহাকাশ বিজ্ঞানটা শেখার জন্য পদার্থ বিজ্ঞানটাও চর্চা করতেন। আবার যেহেতু চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে রসায়ন একেবারে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত সেহেতু মুসলমানরা চিকিৎসা বিজ্ঞানটা শেখার জন্য রসায়নটাও চর্চা করতেন। যার কারণে এ পাঁচটা বিজ্ঞানের শাখার মধ্যে মুসলমানদের অনেক বেশি অবদান ছিল। এ পাঁচটা বিজ্ঞানের শাখার ইতিহাস পড়লেই এগুলো জানা যাবে।
আমরা তাহলে দেখতে পারলাম- গণিত, মহাকাশ বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং এদের শাখা পদার্থ বিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞান এ পাঁচটা শাখার উপর মুসলমানদের খুব বেশি অবদান ছিল। কি ধরণের অবদান ছিল সে বিষয়েও আমাদের জানা প্রয়োজন।
প্রথমেই আসি গণিতে-
গণিতে মুসলমানদের অবদানসবচেয়ে বেশি । আর গণিতের শতকরা ৯৯ ভাগই মুসলমানদের আবিষ্কার।
সংখ্যাতত্ত্ব:
আমরা যে সংখ্যা গুণি, ১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮ ৯। এই সংখ্যার যে এক-এর পরে শূণ্য দিলে দশ (১০) হয়; এটাই মুসলমানদের আবিষ্কার। এটা আবিষ্কার করেছেন আবু জাফর মুহম্মদ মূসা আল খারিজমী। উনিই প্রথম বলেছেন যে, এক এর পরে শূণ্য দিলে দশ হয়।
এর আগে যেগুলো ছিল ওগুলি অনেক কঠিন ছিল। যেমন- রোমান সংখ্যা। তাদের সংখ্যা ছিল এক, পাঁচ, দশ, পঞ্চাশ, এক’শ, পাঁচ’শ, এক হাজার, পাঁচ হাজার এরকম সংখ্যা। এগুলোর সাথে যোগ বিয়োগ করে আমি যেটা চাই সেটা বানিয়ে নিতে হতো। আর ইন্ডিয়ান সংখ্যাটা যেরকম ছিল- এক থেকে নয় পর্যন্ত নয়টা সংখ্যা, আবার দশ থেকে নব্বই পর্যন্ত আরো নয়টা সংখ্যা, আবার একশ থেকে নয়শ পর্যন্ত আরো নয়টা সংখ্যা। এরকম অনেক সংখ্যা। তো ইন্ডিয়ান সংখ্যা কিছুটা সোজা হলেও সংখ্যা এতো বেশি যে সংখ্যা মনে রাখতেই অনেক কষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু মূসা আল খারিজমী উনি সুন্দর একটা পদ্ধতি দিয়ে গেছেন যে, একের পর শূন্য দিলেই দশ হয়ে যায়। দশ সংখ্যাই অংক শেষ।
বীজ গণিত Algebra:
এটাও মূসা আল খারিজমী উনারই আবিষ্কার। উনাকে অবশ্য মুসলমানদের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ গণিতবীদ হিসেবে ধরা হয়। এই আধুনিক বীজ গণিত যেটা, এটা উনিই আবিস্কার করে দিয়ে গেছেন। এর আগে যে বীজ গণিত ছিল সেগুলো এতো জটিল যে, আসলে বুঝাটা খুবই কঠিন। উনি যেটা আবিস্কার করে দিয়েছেন এটা খুবই সোজা এবং এখন পর্যন্ত এটাই চলে আসতেছে। বীজ গণিত ইংরেজী হচ্ছে Algebra (এ্যালজেবরা)। মূসা ইবনে খারিজমী যে বইটা লিখেছিলেন সেটা হচ্ছে, ‘কিতাবুল জাবির ওয়াল মুকারাবা’। ঐ আল জাবিরটাকেই (الجبر, al-ğabr) পরে তারা বানিয়ে ফেলছে এ্যালজাবরা(algebra)।
আর বীজগণিতের উপর যত অবদান সবই মুসলমানদের। যেমন বীজ গণিতের মধ্যে ‘পাওয়ার’এর যে সিস্টেমটা; এটাও মুসলমানদেরই আবিস্কার। আবু কামিল নামে একজন মুসলমান গণিতবিদ ছিলেন উনি এটা প্রথম চালু করেন। পাওয়ার, রুট এগুলোর সিস্টেম। তারপরে অংকের যে যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ এই চিহ্ণগুলিও মুসলমানদেরই দেয়া। এই চিহ্ণগুলি আবিস্কার করেছিলেন, আবুল হাসান ইবনে আলী কালাসাদি।
মুসলিম মনীষা গ্রন্থের মতে, মুহম্মদ মুসা আল খারিজমির বীজগণিত প্রাঞ্জল ও সরল ভঙ্গিতে লেখা, তাতে প্রায় ৮০০ ধরনের উদাহরণ দেয়া আছে। তিনি একত্রীকরণ ও দুই ডিগ্রির সমীকরণ সম্পর্কে আলোচনা করে তার হরণ ও পূরক সম্পর্কেও বর্ণনা দিয়েছেন। সমীকরণকে সমাধান করার প্রায় ছয়টি নিয়ম তিনি আবিষ্কার করেন।
আমরা অংকের সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে কোন অজানা মানকে X অথবা Y হিসেবে ধরে নিয়ে তার সমাধান বের করি। এই পদ্ধতিটাও আল খারিজমির আবিস্কার দেয়া।
আমরা সাধারণত কোন সমীকরণ সমাধান করে যখন X অথবা Y-এর একটি করে মান পাই। যেগুলো এক ঘাত সমীকরণ নামে পরিচিত। আবার দ্বিঘাত সমীকরণে দুটি মান পাওয়া যায়। এই দুই ধরণের সমীকরণের বিশ্লেষণধর্মী ব্যাখা তুলে ধরেন আলখারিজমি।
যেমন X+1=0, এটি একটি একঘাত সমীকরণ যার একটি মান 1। আবার X2-5X+6=0 একটি দ্বিঘাত সমীকরণ যেখানে এর মান দুটি 3 অথবা 2.
তাঁর এলজাবরা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে গণিত জগতে এর উপযোগীতা অভাবনীয় বেড়ে যায়। মধ্যযুগের আর কোন গণিতবিদই গণিত জগতে তার সমান্তরাল কর্ম উপস্থাপন করে যেতে পারেননি। তিনি গণিতের লগারিদম শাখাটিও তিনি উন্নয়ন করেন।
যেমন X+1=0, এটি একটি একঘাত সমীকরণ যার একটি মান 1। আবার X2-5X+6=0 একটি দ্বিঘাত সমীকরণ যেখানে এর মান দুটি 3 অথবা 2.
তাঁর এলজাবরা আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে গণিত জগতে এর উপযোগীতা অভাবনীয় বেড়ে যায়। মধ্যযুগের আর কোন গণিতবিদই গণিত জগতে তার সমান্তরাল কর্ম উপস্থাপন করে যেতে পারেননি। তিনি গণিতের লগারিদম শাখাটিও তিনি উন্নয়ন করেন।
আল-জাবির ওয়াল-মুকাবিলা:
বীজগণিতের উপর লেখা তাঁর এ বইটি সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত। এই বইটির নাম অনুসারে এলজেবরা বা বীজগণিত নামকরণ করা হয়। এ বইটি লাতিন ভাষায় অনুবাদ করা হয় দ্বাদশ শতকে। অনুবাদ কর্মের মধ্য দিয়ে এই নতুন বিজ্ঞান পশ্চিমা জগতে প্রবেশের সুযোগ পায়। এর আগে ইউরোপের কাছে বীজগণিত ছিলো একটি অচেনা বিষয়। ইউরোপীয়রা এ বিষয়ে ছিলো পুরোপুরি অজ্ঞ।
এক নজরে `কিতাব আল জাবির ওয়াল মুকাবালা’:
বইটি পাঁচখন্ডে বিভক্ত।
প্রথম অংশে তিনি দ্বিঘাত সমীকরণগুলোকে ছয়ভাগে বিভক্ত করে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে আলোচনা করেন। দ্বিঘাত সমীকরণে যে দুটো মূল বিষয় খারেজমী সর্বপ্রথম উল্লেখ করেন। এবং এটি সমাধান করেন।
দ্বিতীয় অংশে তিনি বীজগণিতের সমীকরণের জ্যামিতিক সমাধান নির্ণয় করেন।
চতুর্থ খন্ডে তিনি করণী অপসারণ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।
দশম শতাব্দীর ইউসূফ রচিত ‘মাফাতিহুল উলুম’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়।
বইটি পাঁচখন্ডে বিভক্ত।
প্রথম অংশে তিনি দ্বিঘাত সমীকরণগুলোকে ছয়ভাগে বিভক্ত করে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে আলোচনা করেন। দ্বিঘাত সমীকরণে যে দুটো মূল বিষয় খারেজমী সর্বপ্রথম উল্লেখ করেন। এবং এটি সমাধান করেন।
দ্বিতীয় অংশে তিনি বীজগণিতের সমীকরণের জ্যামিতিক সমাধান নির্ণয় করেন।
চতুর্থ খন্ডে তিনি করণী অপসারণ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।
দশম শতাব্দীর ইউসূফ রচিত ‘মাফাতিহুল উলুম’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়।
দ্বিঘাত সমীকরণ:
এটাও আবিস্কার করেছেন মুসলমানরা। তারপরে দ্বিপদী উপপাদ্য; এটাও প্রথম দেন মুসলমানরা। আবু বক্বর ইবনে হুসাইন আল কারাজি প্রথম এই দ্বিপদী উপপাদ্যটা দেন। পরবর্তীতে ওমর খাইয়াম আবার এই দ্বিপদী উপপাদ্যটার উপর আরো কাজ করেন এবং উনি এই দ্বিপদী উপপাদ্যের মাধ্যমেই যেকোন সংখ্যার যেকোন তম রুট বের করার একটা পদ্ধতি বের করেন। পরবর্তীতে পদ্ধতিটা হারিয়ে যায় তবে উনি যে এই পদ্ধতিটা বের করেছিলেন এটা অন্যান্য মুসলমান বিজ্ঞানীদের বইয়ে এই পদ্ধতিটা পাওয়া যায়।
ত্রিকোণমিতি:
এটার উপরেও মুসলমানদের অনেক অবদান। রোমানরা ত্রিকোণমীতি প্রথম আবিস্কার করে কিন্তু রোমানরা ত্রিকোণমীতির যে ব্যাখ্যা দিত, সে ব্যাখ্যা শুনে মানুষ ত্রিকোণমীতি বিমুখ ছিল। পরবর্তীতে মুসলমান একজন গণিতবিদ মুহম্মদ ইবনে জাবির আল হারানী ওয়াল বাত্তানী তিনি প্রথম ত্রিকোণমীতি সম্পর্কে সুন্দর ব্যাখ্যা দেন। যারফলে আবার সবাই ত্রিকোণমীতির দিকে ঝুঁকে পড়ে। উনি অনেকগুলো ত্রিকোণমীতির ফর্মুলা দিয়ে গিয়েছিলেন। যেমন একটা ফর্মুলা আছে ten=sin/cos আবার ten এর টেবিলটাও মুসলমানদের আবিস্কার করা। এটা আবিস্কার করেন আবু জাফর মুহম্মদ মূসা আল খারিজমী।
এ্যালগরিদম:
তারপরে এ্যালগরিদম তৈরী করার পদ্ধতিটাও মুসলমানদেরই করা। আবু জাফর মুহম্মদ মূসা ইবনে আল খারিজমী প্রথম এটা আবিস্কার করেন। এই এ্যালগরিদমের ফর্মুলাটা প্রয়োগ করেই কম্পিউটারের ক্যালকুলেশনের লজিকটা তৈরী করা হয়। এক কথায় আসলে বর্তমানে কম্পিউটারের আবিস্কারের পেছনেও মুসলমানদেও অবদান রয়ে গেছে। উনি যদি এ্যালগরিদম তৈরীর পদ্ধতিটা আবিস্কার না করতেন তাহলে হয়তো বর্তমানে কম্পিউটার আবিস্কার নাও হতে পারতো।
Comments
Post a Comment