গত ৬ জুন ছিল পরিবেশ দিবস। পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হওয়া এখন সময়ের দাবি। আর পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অর্গানিক ফুডের কোনো বিকল্প হয় না। এসব নিয়ে লিখেছেন সুমাইয়া হাবীবা
সুস্বাস্থ্যের জন্য চাই নিরাপদ আহার। বর্তমানে ভেজাল খাবারের জলোচ্ছ্বাসে নিরাপদ আহার কথাটা নিঃসন্দেহে মনে কৌতূহল জাগায়। অর্গানিক ফুডকে বলা হয় নিরাপদ আহার। অর্গানিক ফুড কথাটা ইদানীং বেশ শোনা যাচ্ছে। অর্গানিক ফুড আসলে কী? কোনো ধরনের কৃত্রিম সার, রাসায়নিক ইত্যাদি ব্যবহার ছাড়াই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলকেই অর্গানিক বলা হয়। ফলে ফসলের ক্ষতিকারক দিক থাকে না।
বাংলাদেশে অর্গানিক ফুডের তেমন প্রচলন না থাকলেও বহির্বিশ্বে অর্গানিক ফুডের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। উন্নত বিশ্বে অর্গানিক ফুডের প্রসারে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। বিভিন্ন এনজিও এবং স্বাস্থ্য সংস্থা ইত্যাদি মানুষকে অর্গানিক ফুডের উপকারিতা তুলে ধরে মোটিভেশনের কাজ করে থাকে। প্রতি বছর কোটি কোটি ডলার বাজেট ব্যয় হয় অর্গানিক ফুড বা নিরাপদ আহার বিষয়ক প্রচারণায়।
শুরুতে আন্তর্জাতিক বিশ্বের নানা প্রান্তে অর্গানিক ফুড কথাটার বিরোধিতা করা হয়েছিল। বিজ্ঞানীরাও দ্বিধান্বিত ছিলেন এর উপকারিতা নিয়ে। তবে, ২০১৪ সালে নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক প্রমাণ করে দিয়েছেন অর্গানিক ফুডের উপকারিতা। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে সাধারণ সারমিশ্রিত ফসলের চেয়ে অর্গানিক ফসলে কীটনাশকের পরিমাণ এক চতুর্থাংশের চেয়েও কম এবং বিষাক্ত ধাতব উপাদানও কম। তাই এতে ক্যান্সার প্রতিরোধী অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট অনেক বেশি মাত্রায় থাকে। লাভ করা যায় দীর্ঘায়ু। এ ছাড়া রাসায়নিক ব্যবহার না করার কারণে জমির উর্বরতা বজায় থাকে। ফলে ফলন বেশি দিন পাওয়া যাবে।
অর্গানিক ফুডকে জিএম ফুডের বিপরীত ফুড বলা হয়। জিএম ফুড হলো জেনেটিক্যালি মডিফাইড ফুড। সাধারণভাবে আমাদের কাছে যা হাইব্রিড নামে পরিচিত। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ক্রমহ্রাসমান ফসলি জমির দরুন একসময় এই জিএম ফুডকে বিজ্ঞানের কল্যাণে প্রাপ্ত নিয়ামত ভাবা হলেও এখন আর তা ভাবা হচ্ছে না। বর্তমানে প্রায় সব বিজ্ঞানীই এ ব্যাপারে একমত জিএম ফুডে খরচের চেয়ে লাভ বেশি হলেও শারীরিকভাবে ক্ষতি ঢের বেশি। তাই জিএম ফুডের জায়গা দখল করছে অর্গানিক ফুড। অর্গানিক ফুডের আওতায় ধান, গম, আলু, পটোল ও শাকসবজিসহ অন্যান্য কৃষিজাতদ্রব্য ও গবাদিপশু রয়েছে।
আমাদের দেশে অর্গানিক ফুড কথাটি গত কয়েক বছর ধরে শোনা গেলেও এখন অবধি অনেকেই জানে না অর্গানিক ফুড সম্পর্কিত তথ্য। দু-এক বছর আগেও গ্রামাঞ্চলে তো নয়ই, শহুরে শ্রেণীতেও খুব অল্প সংখ্যক মানুষ অর্গানিক ফুডের সাথে পরিচিত ছিলেন। তবে, ইদানীং অবস্থা পাল্টেছে। সুপারশপগুলো ঘুরে দেখা যায় লোকজন অর্গানিক ফুডের ব্যাপারে আগ্রহী। অর্থাৎ, বাজারে অর্গানিক ফুডের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে।
বাজারে অর্গানিক ফুডের চাহিদা সৃষ্টি হওয়া সত্ত্বেও সেভাবে অর্গানিক ফুডের উৎপাদন হচ্ছে না। অনেক কৃষক জানেন না অর্গানিক ফুড কী। বিএডিসির (বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন) কৃষি কর্মকর্তা হাসনে মাহজাবীন জানালেন, অর্গ্যানিক ফুড অবশ্যই ভালো তবে, দরিদ্র কৃষকদের সেটি বোঝানো খুব মুশকিল। তারা চায় কম খরচে বেশি লাভ। তাই এখনো তেমনভাবে গ্রামাঞ্চলে অর্গ্যানিক ফুডের প্রসার ঘটছে না। সরকারি পর্যায়ে অর্গ্যানিক ফুডের উৎপাদন খরচ কমানো যায় কি না সেটির গবেষণা চলছে।
বাংলাদেশে অর্গ্যানিক ফুডের প্রথম প্রচলনকারী হলেন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ফরহাদ মাজহার। কয়েক দশক ধরে তিনি নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্গ্যানিক ফুডের বাজার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। তার নয়া কৃষি আন্দোলন মূলত অর্গ্যানিক ফুড বা নিরাপদ আহারের আন্দোলনেরই প্রতিরূপ। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ারে তার একটি বিশাল প্রজেক্টও রয়েছে। ধীরে ধীরে এ প্রজেক্ট আজ বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে বলা যায়। র্দীঘ দিনের প্রচেষ্টায় সে অঞ্চলের কৃষকদের সচেতন করতেও সক্ষম হয়েছেন তিনি। তার সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে অনেকেই অর্গ্যানিক ফুডের দিকে ঝুঁকেছেন। কেউ কেউ ব্যবসায়ও শুরু করেছেন। বাইরে থেকে আমদানিও হচ্ছে অর্গ্যানিক খাদ্যদ্রব্য।
তবে, ফসলের পাশাপাশি অনেকে গবাদি পশুও উৎপাদন করছেন অর্গ্যানিক পদ্ধতিতে। এ বি এম ওমর মারুফ তাদের একজন। ঢাকার মানিকদীতে গড়ে তুলেছেন অর্গ্যানিক ছাগলের খামার। তিনি জানালেন, ব্যবসায়ের মাধ্যমে নিজস্ব লাভের পাশাপাশি মানবসেবার ব্রত থেকেই এ উদ্যোগ নেয়া। যেহেতু এখনো সেরকমভাবে অর্গ্যানিক খাবারের বাজার সৃষ্টি হয়নি তাই লাভটা অনেক কম। তবে, আশা আছে অচিরেই মানুষ এর গুরুত্ব বুঝতে পারবে।
এরকম অনেককেই অর্গ্যানিক ফুডের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী দেখা গেল। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে অর্গ্যানিক ফুড উৎপন্ন করছেন। শাহজাহান ইসলাম সেরকমই একজন। সাভারে শাহজাহান ব্যক্তিগত উদ্যোগে অর্গ্যানিক ফসল উৎপাদন করছেন। আপাতত স্বল্পপরিসরে। তার মতে, অনেকেই অর্গ্যানিক ফুডের ব্যাপারে উৎসুক। প্রচারণা কম থাকায় এর বাজারটি এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়। ইন্টারনেট থেকে অর্গ্যানিক ফুডের সম্পর্কে জেনে এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছেন তিনি। ভবিষ্যতে বৃহৎ পরিসরে করার ইচ্ছে আছে জানালেন।
মজিবুর রহমান একজন সমাজ উন্নয়ন কর্মী। অর্গ্যানিক ফুডের ব্যাপারে প্রচারণামূলক র্কমকাণ্ড পরিচালনা করছেন। জেলায় জেলায় গিয়ে মানুষকে সচেতন করছেন। উৎপাদক পর্যায়ে এর উপকারিতা বোঝাচ্ছেন। অর্গ্যানিক ফুডের আকাশচুম্বী দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে বলেন, বেসরকারিভাবে উদ্যোগের ফলে দাম অতিরিক্ত হয়ে যায়। এটাকে কৃষকপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। কৃষক শুরুতেই আগ্রহী হবেন না। তবে, সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে অন্তত প্রাথমিক বছরগুলোতে ভর্তুকির মাত্রা বাড়িয়ে চাষের উদ্যোগ নিলে কৃষকদের সচেতন করা সম্ভব হতে পারে বলে মনে করেন তিনি। বিশ্বকে সুস্থ সুন্দর রাখতে অর্গ্যানিক ফুড অপরিহার্য।
প্রায় সব ফল, কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে সবরকম খাবার জিনিসেই, শিশুখাদ্যে পর্যন্ত ভেজাল যখন মানুষকে শেষ সীমায় নিয়ে যায় তখন ভেজালের ভিড়ে ভেজালমুক্ত খাবার আল্লাহর নিয়ামত ভাবছেন সাধারণ মানুষ। তবে, অর্গ্যানিক ফুড নিয়ে বিরোধীদের সংখ্যাও কম নয়। অনেকেই এর বাস্তব গ্রহণযোগ্যতা বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দরিদ্র রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এর উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের মতে, র্বতমানের অর্গ্যানিক ফুড সোনার হরিণ। যা বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। সাধারণ খাবার কিনতেই যেখানে নিম্নবিত্তদের নাভিশ্বাস উঠছে সেখানে খাদ্যদ্রব্য এ রকম ব্যয়বহুল হয়ে গেলে খাওয়াই ছেড়ে দিতে হতে পারে।
-dailynayadiganta
Comments
Post a Comment