সরল অনুবাদ:
১) নিশ্চিত ভাবেই সফলকাম হয়েছে মুমিনরা।
২) যারা নিজেদের নামাযে বিনয়ী ও নম্র।
৩) যারা বাজে বা বেহুদা কথা ও কাজ থেকে দুরে থাকে।
৪) যারা যাকাতের পথে কর্মতৎপর হয়।
৫) এবং যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।
নামকরন:
সুরার নামকরন সাধারণত দুই ভাবে হয়ে থাকে-
১. বহুল আলোচিত শব্দ (শব্দ ভিত্তিক)। যেমনঃ নাস, ফালাক
২. বিষয় ভিত্তিক- যেমনঃ সুরা ফাতেহা, ইখলাস
এ সুরাটি ১ম আয়াতের “আল মুমিনুন” শব্দ থেকে নামকরন করা হয়েছে।
নাযিলের সময়কাল/ শানে নুযুল:
বর্ণনাভংগী ও বিষয়বস্তু উভয়টি থেকে জানা যায়, এ সূরাটি মক্কী যুগের মাঝমাঝি সময় নাযিল হয় । প্রেক্ষাপটে পরিষ্কার অনুভব করা যায় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়া সাল্লাম ও কাফেরদের মধ্যে ভীষণ সংঘাত চলছে । কিন্তু তখনো কাফেরদের নির্যাতন নিপীড়ন চরমে পৌঁছে যায়নি । ৭৫-৭৬ আয়াত থেকে পরিষ্কার সাক্ষ পাওয়া যায় যে, মক্কী যুগের মধ্যভাগে আরবে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল বলে নির্ভরযোগ্য বর্ণনা থেকে জানা যায় ঠিক সে সময়ই এ সূরাটি নাযিল হয় । উরওয়াহ ইবনে যুবাইরের একটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, এ সূরা নাযিল হওয়ার আগেই হযরত উমর (রা) ইসলাম গ্রহন করেছিলেন । তিনি আবদুর রহমান ইবনে আবদুল কারীর বরাত দিয়ে হযরত উমরের (রা) এ উক্তি উদ্বৃত করেছেন যে, এ সূরাটি তাঁর সামনে নাযিল হয় । অহী নাযিলের সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অবস্থা কি রকম হয় তা তিনি স্বচক্ষেই দেখেছিলেন এবং এ অবস্থা অতিবাহিত হবার পর নবী (সা) বলেন, এ সময় আমার ওপর এমন দশটি আয়াত নাযিল হয়েছে যে, যদি কেউ সে মানদন্ডে পুরোপুরি উতরে যায় তাহলে সে নিশ্চিত জান্নাতে প্রবেশ করবে । তারপর তিনি এ সূরার প্রাথমিক আয়াতগুলো শোনান ।
বক্তব্য ও আলোচ্য বিষয়:
এই সুরাটির মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে রাসূল (সা:) এর আনুগত্য।
তিলাওয়াতকৃত ৫ টি আয়াতের মূল বিষয়বস্তু হলো, যারা এ নবীর কথা মেনে নিয়েছে তাদের মধ্যে অমুক অমুক গুনাবলী সৃষ্টি হচ্ছে এবং নিশ্চিতভাবে এ ধরনের লোকেরাই দুনিয়ায় ও আখেরাতে সাফল্য লাভের যোগ্য হয় ।
ইমাম নাসাঈ তার কিতাবের তাফসীর অধ্যায়ে ইয়াজীদ ইবনে কাবনুস থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি হযরত আয়েশা (রা:) কে প্রশ্ন করেছিলেন : রাসূল (সা:) এর চরিত্র কেমন ছিল? তিনি বলেন, তার চরিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে। অত:পর তিনি সূরা মুমিনুনের ১ম দশটি আয়াত তেলাওয়াত করে শোনান। এবং বলেন এসব ছিল রাসূল (সা:) এর চরিত্র।
পটভূমি:
অত্র সুরা বিশেষ করে তেলাওয়াতকৃত আয়াতগুলো নাজিলের মক্কার কাফেররা যেমন ছিল ইসলামের চরম বিরোধী তেমনি পার্থিব উপকরণ সব ছিল তাদের হাতের মুঠোয় (বাণিজ্য)। অপরদিকে মুসলমানদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। (আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানগত) । এই অবস্থায় কাফেররা নিজেদের অধিক সফল এবং মুসলমানদের ব্যর্থ মনে করত। তখন মূলত মুমিনদেরকে প্রকৃত সফলতার ঘোষণা দিয়ে এ আয়াতগুলি নাজিল করা হয়।
প্রকৃত সফলতার অর্থ:
তাফসীর কারকগণ ব্যাখ্যা করেছেন “কোন একটি সুন্দর দালানে এক ব্যক্তি ৫দিন থাকতে পারবে এবং যদি কুড়েঘরে থাকে তবে সারাজীবন থাকতে পারবে- এক্ষেত্রে একজন বুদ্ধিমান কোনটি বেছে নেবে।
অথচ আখেরাতে চিরজীবনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থা আছে।
আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা:
১। নিশ্চিত ভাবে সফলকাম হয়েছে মুমিনরা।
মু'মিনরা বলতে এমন লোকদেরকে বুঝানো হয়েছে যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দাওয়াত গ্রহণ করেছে, তাঁকে নিজেদের নেতা ও পথপ্রদর্শক বলে মেনে নিয়েছে এবং তিনি জীবন যাপনের যে পদ্ধতি পেশ করেছেন তা অনুসরণ করে চলতে রাজি হয়েছে৷
মূল শব্দ হচ্ছে 'ফালাহ' ৷ ফালাহ মানে সাফল্য ও সমৃদ্ধি ৷ এটি ক্ষতি, ঘাটতি , লোকসান ও ব্যর্থতার বিপরীত অর্থবোধক শব্দ৷ যেমন “আফলাহাল রজুল” মানে হচ্ছে , অমুক ব্যক্তি সফল হয়েছে, নিজেদের লক্ষে পৌঁছে গেছে, প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী হয়ে গেছে, তার প্রচেষ্টা ফলবতী হয়েছে, তার অবস্থা ভালো হয়ে গেছে৷
“ক্বদ আফলাহা” "নিশ্চিতভাবেই সফলতা লাভ করেছে"৷ এ শব্দগুলো দিয়ে বাক্য শুরু করার গুঢ় তাৎপর্য বুঝতে হলে যে পরিবেশে এ ভাষণ দেয়া হচ্ছিল তা চোখের সামনে রাখা অপরিহার্য ৷ তখন একদিকে ছিল ইসলামী দাওয়াত বিরোধী সরদারবৃন্দ ৷ তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য উন্নতির পর্যায়ে ছিল৷ তাদের কাছে ছিল প্রচুর ধন-দওলত ৷ বৈষয়িক সমৃদ্ধির যাবতীয় উপাদান তাদের হাতের মুঠোয় ছিল ৷ আর অন্যদিকে ছিল ইসলামী দাওয়াতের অনুসারীরা ৷ তাদের অধিকাংশ তো আগে থেকেই ছিল গরীব ও দুর্দশাগ্রস্ত ৷ কয়েকজনের অবস্থা সচ্ছল থাকলেও অথবা কাজ - কারবারের ক্ষেত্রে তারা আগে থেকেই সফলকাম থাকলেও সর্বব্যাপী বিরোধীতার কারণে তাদের অবস্থাও এখন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো৷ এ অবস্থায় যখন ''নিশ্চিতভাবেই মু'মিনরা সফলকাম হয়েছে'' বাক্যাংশ দিয়ে বক্তব্য শুরু করা হয়েছে তখন এ থেকে আপনা আপনি এ অর্থ বের হয়ে এসেছে যে, তোমাদের সাফল্য ও ক্ষতির মানদন্ড ভুল, তোমাদের অনুমান ত্রুটিপূর্ণ, তোমাদের দৃষ্টি দূরপ্রসারী নয়, তোমাদের নিজেদের যে সাময়িক ও সীমিত সমৃদ্ধিকে সাফল্য মনে করছো তা আসল সাফল্য নয়, তা হচ্ছে ক্ষতি এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যে অনুসারীদেরকে তোমরা ব্যর্থ ও অসফল মনে করছো তারাই আসলে সফলকাম ও সার্থক ৷ এ সত্যের দাওয়াত গ্রহণ করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বরং তারা এমন জিনিস লাভ করেছে যা তাদেরকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জায়গায় স্থায়ী সমৃদ্ধি দান করবে৷ আর ওকে প্রত্যাখান করে তোমরা আসলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ এর খারাপ পরিণতি তোমরা এখানেও দেখবে এবং দুনিয়ার জীবনকাল শেষ করে পরবর্তী জীবনেও দেখতে থাকবে৷
এ হচ্ছে এ সূরার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু ৷ এ সূরার সমগ্র ভাষণ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ বক্তব্যটিকে মনের মধ্যে বদ্ধমূল করে দেবার জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে৷
২) যারাঃ নিজেদের নামাযে বিনয়াবনত হয়।
এখান থেকে নিয়ে ৯ আয়াত পর্যন্ত মু'মিনদের যে গুণাবলীর কথা বলা হয়েছে তা আসলে মু'মিনরা সফলকাম হয়েছে এ বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তিস্বরূপ ৷ অন্য কথায়, বলা হচ্ছে, যেসব লোক এ ধরনের গুণাবলীর অধিকারী তারা কেনইবা সফল হবেনা ৷ এ গুনাবলী সম্পন্ন লোকেরা ব্যর্থ ও অসফল কেমন করে হতে পারে? তারাই যদি সফলকাম না হয় তাহলে আর কারা সফলকাম হবে৷
মূল শব্দ হচ্ছে ''খুশূ''৷ এর আসল মানে হচ্ছে করোর সামনে ঝুঁকে পড়া, দমিত বা বশীভূত হওয়া , বিনয় ও নম্রতা প্রকাশ করা৷ এ অবস্থাটার সম্পর্ক মনের সাথে এবং দেহের বাহ্যিক অবস্থার সাথেও৷মনের খূশূ' হচ্ছে, মানুষ কারোর ভীতি, শ্রেষ্ঠত্ব, প্রতাপ ও পরাক্রমের দরুন সন্ত্রস্ত ও আড়ষ্ট থাকবে ৷ আর দেহের খুশূ' হচ্ছে, যখন সে তার সামনে যাবে তখন মাথা নত হয়ে যাবে, অংগ-প্রত্যংগ ঢিলে হয়ে যাবে, দৃষ্টি নত হবে, কন্ঠস্বর নিম্নগামী হবে এবং কোন জবরদস্ত প্রতাপশালী ব্যক্তির সামনে উপস্থিত হলে মানুষের মধ্যে যে স্বাভাবিক ভীতির সঞ্চার হয় তার যাবতীয় চিহ্ন তার মধ্যে ফুটে উঠবে ৷ নামাযে খুশূ' বলতে মন ও শরীরের এ অবস্থাটা বুঝায় এবং এটাই নামাযের আসল প্রাণ ৷
নামাযে খুশু বলতে বিনয় ও নম্র হওয়া বুঝায়। খশুর আভিধানিক অর্থ স্থিরতা। শরীয়তের পরিভাষায় এর মানে অন্তরে স্থিরতা থাকা। অর্থ্যাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুর কল্পনা অন্তরে ইচ্ছাকৃত ভাবে না করা এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্থির রাখা।
দিলের খুশু হয় তখন যখন কারো ভয়ে বা দাপটে দিল ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আর দেহের খুশু এভাবে প্রকাশ পায় যে, কারো সামনে গেলে তার মাথা নিচু হয়ে যায়। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হয়ে পড়ে চোখের দৃষ্টি নত হয়ে আসে, গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়।
যেসব কাজে নামাযে খুশু সৃষ্টিতে বাধা দেয়:
(১) নামাযের মধ্যে নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে খেলা করা বা নাড়াচাড়া করা।
হাদীস- একবার নবী (সা:) এক ব্যক্তিকে নামাযের মধ্যে মুখের দাড়ী নিয়ে খেলা করতে দেখে বললেন- “যদি এ লোকটির দিলে খুশু থাকত তাহলে তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গের উপরও খুশু থাকত। (বায়হাকী)
(২) নামাযে এদিক ওদিক তাকালে নামাযে একগ্রতা বা খুশু নষ্ট হয়ে যায়।
(৩) নামাযে ছাদ বা আকাশের দিকে তাকালে নামাযের খুশু নষ্ট হয়ে যায়।
নবী করিম (সা:) বলেন- লোকেরা যেন নামাযে তাদের চোখকে আকাশমুখী না করে। (কেননা তাদের চোখ) তাদের দিকে ফিরে নাও আসতে পারে।
(৪) নামাযে হেলা-ফেলা করা ও নানাদিকে ঝুকে পড়া।
(৫) সিজদায় যাবার সময় বসার জায়গা বা সিজদার জায়গা বার বার পরিস্কার করলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়। (তবে ক্ষতিকারক হলে একবার সরানো যাবে)
মহানবী (সা:) বলেন- কোন ব্যক্তি যেন নামাযের অবস্থায় (সিজদার জায়গা হতে) কংকর না সরায়। কেননা আল্লাহর রহমত নামাযী ব্যক্তির উপর প্রসারিত হয়। (আহমেদ, নাসায়ী, তিরমিযী, আবু দাউদ, ইবনে মাযাহ)
(৬) একটানা গর্দান খাড়া করে দাড়ানো এবং খুব কর্কশ স্বরে কোরআন পড়া কিংবা গীতের স্বরে কুরআন পাঠ।
(৭) জোরে জোরে হাই এবং ঢেকুর তোলা। ইচ্ছা করে গলা খেকরা বা কাশি দিলে নামাযের একাগ্রতা নষ্ট হয়।
রাসূল (সা:) বলেন- নামাযে হাই ওঠে শয়তানের প্রভাব থেকে যদি কারো হাই ওঠে তার উচিত সে যেন সাধ্যমতো হাই প্রতিরোধ করে। (মুসলিম, তিরমিযী)
(৮) তাড়াহুড়ো করে নামায আদায় করা। নামাযে রুকু সিজদা কিয়াম সঠিক ভাবে আদায় না করা।
নবী (সা:) বলেন- মদখোর, ব্যভিচারী ও চুরি করা কবীরা গুনাহ এবং তার সাজাও খুব তবে সবচেয়ে জঘন্য চুরি হলো সেই যে ব্যক্তি নামাযে চুরি করে। সাহাবীরা বললেন নামাযে কিভাবে চুরি হয়। রাসূল (সা:) বললেন নামাযে রুকু ও সিজদা ঠিকমতো না করা। (মালেক, আহমেদ, দারেমী)
(৯) নামাযীর সামনে পর্দায় কোন ছবি থাকলে নামাযে খুশু বা একাগ্রতা নষ্ট হয়ে যায়।
নামাযে খুশু সৃষ্টির জন্য যা করতে হবে:
(১) আল্লাহ তায়ালাকে সবসময় হাজির নাজির জানা।
হাদীসে জীবরীলে ইহসান সম্পর্কে মহানবী (সা:) কে রাসূল (সা:) প্রশ্ন করলে তার প্রতিউত্তরে তিনি বলেন, তুমি এভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে (নামাযে) যেন তুমি আল্লাহকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তোমার পক্ষে এটা সম্ভব না হয়। তবে তুমি অবশ্যই মনে করে নেবে যে আল্লাহ তোমাকে দেখছেন।
(২) নামাযে পঠিত দোয়া, কালাম অন্তর থেকে পড়া।
(৩) নামাযে খুশু সৃষ্টি করার জন্য নামাযীর দৃষ্টি সিজদার দিকে থাকবে।
(৪) নামাযে একাগ্রতা সৃষ্টির জন্য নামাযে যা পড়া হয় তার অর্থ জানা।
৫) যারা বাজে বা বেহুদা কথা ও কাজ থেকে দুরে থাকে।
মূলে “লাগঔ” শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে৷ এর মানে এমন প্রত্যেকটি কথা ও কাজ যা অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন ও যাতে কোন ফল লাভও হয় না৷ যেসব কথায় বা কাজে কোন লাভ হয় না, যেগুলোর পরিণাম কল্যাণকর নয়, যেগুলোর আসলে কোন প্রয়োজন নেই, যেগুলোর উদ্দেশ্যও ভালো নয়- সেগুলোর সবই 'বাজে' কাজের অন্তরভূক্ত৷
আয়াতের পূর্ণ বক্তব্য হচ্ছে এই যে, তারা বাজে কথায় কান দেয় না এবং বাজে কাজের দিকে দৃষ্টি ফেরায় না৷ সে ব্যাপারে কোন প্রকার কৌতুহল প্রকাশ করে না৷ যেখানে এ ধরনের কথাবার্তা হতে থাকে অথবা এ ধরণের কাজ চলতে থাকে সেখানে যাওয়া থেকে দূরে থাকে৷ তাতে অংশগ্রহণ করতে বিরত হয় আর যদি কোথাও তার সাথে মুখোমুখি হয়ে যায় তাহলে তাকে উপেক্ষা করে এড়িয়ে চলে যায় অথবা অন্ততপক্ষে তা থেকে সম্পর্কহীন হয়ে যায়৷ একথাটিকেই কোরআনের অন্য জায়গায় সূরা আল ফুরকানের ৭২ নং আয়াতে এভাবে বলা হয়েছে
''যখন এমন কোন জায়গা দিয়ে তারা চলে যেখানে বাজে কথা হতে থাকে অথবা বাজে কাজের মহড়া চলে তখন তারা ভদ্রভাবে সে জায়গা অতিক্রম করে চলে যায়৷''
এ ছোট্ট সংক্ষিপ্ত বাক্যটিতে যে কথা বলা হয়েছে তা আসলে মু'মিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলীর অন্তরভুক্ত৷ মু'মিন এমন এক ব্যক্তি যার মধ্যে সবসময়ে দায়িত্বানুভূতি সজাগ থাকে সে মনে করে দুনিয়াটা আসলে একটা পরীক্ষাগৃহ৷ যে জিনিসটিকে জীবন, বয়স, সময় ইত্যাদি বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে সেটি আসলে একটি মাপাজোকা মেয়াদ৷ তাকে পরীক্ষা করার জন্য এ সময়-কালটি দেয়া হয়েছে৷ যে ছাত্রটি পরীক্ষার হয়ে বসে নিজের প্রশ্নপত্রের জবাব লিখে চলছে সে যেমন নিজের কাজকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে পূর্ণ ব্যস্ততা সহকারে তার মধ্যে নিজেকে নিমগ্ন করে দেয়৷ সেই ছাত্রটি যেমন অনুভব করে পরীক্ষার এ ঘন্টা ক'টি তার আগামী জীবনের চূড়ান্ত ভাগ্য নির্ধারণকারী এবং এ অনুভূতির কারণে সে এ ঘন্টাগুলোর প্রতিটি মুহুর্তে নিজের প্রশ্নপত্রের সঠিক জবাব লেখার প্রচেষ্টায় ব্যয় করতে চায় এবং এগুলোর একটি সেকেন্ডে বাজ কাজে নষ্ট করতে চায় না, ঠিক তেমনি মু'মিনও দুনিয়ার এ জীবনকালকে এমন সব কাজে ব্যয় করে যা পরিণামের দিক দিয়ে কল্যাণকর৷ এমনকি সে খেলাধূলা ও আনন্দ উপভোগের ক্ষেত্রেও এমন সব জিনিস নির্বাচন করে যা নিছক সময় ক্ষেপণের কারণ হয় না বরং কোন অপেক্ষাকৃত ভালো উদ্দেশ্যপূর্ণ করার জন্য তাকে তৈরী করে৷ তার দৃষ্টিতে সময় 'ক্ষেপণ' করার জিনিস হয় না বরং ব্যবহার করার জিনিস হয় ৷ অন্য কথায়,সময় কাটানোর জিনিস নয়- কাজে 'খাটানোর' জিনিস৷
এ ছাড়াও মু'মিন হয় একজন শান্ত-সমাহিত ভারসাম্যপূর্ণ প্রকৃতির অধিকারী এবং পবিত্র-পরিচ্ছন্ন স্বভাব ও সুস্থ রুচিসম্পন্ন মানুষ৷ বেহুদাপনা তার মেজাজের সাথে কোন রকমেই খাপ খায় না৷ সে ফলদায়ক কথা বলতে পারে, কিন্তু আজেবাজে গল্প মারা তার স্বভাব বিরুদ্ধ৷ সে ব্যাংগ, কৌতুক, ও হালকা পরিহাস পর্যন্ত করতে পারে কিন্তু উচ্ছল ঠাট্টা-তামাসায় মেতে উঠতে পারে না, বাজে ঠাট্টা -মস্করা ও ভাঁড়ামি বরদাশত করতে পারে না এবং আনন্দ-ফূর্তি ও ভাঁড়ামির কথাবার্তাকে নিজের পেশায় পরিণত করতে পারে না৷ তার জন্য তো এমন ধরনের সমাজ হয় একটি স্থায়ী নির্যাতন কক্ষ বিশেষ, যেখানে কারো কান কখনো গালি-গালাজ, পরনিন্দা, পরচর্চা, অপবাদ, মিথ্যা কথা, কুরুচিপূর্ণ গান-বাজনা ও অশ্লীল কথাবার্তা থেকে নিরাপদ থাকে না৷ আল্লাহ তাকে জান্নাতের আশা দিয়ে থাকেন তার একটি অন্যতম নিয়ামত তিনি এটাই বর্ণনা করেছেন যে, '' সেখানে তুমি কোন বাজে কথা শুনবে না৷''
রাসূল (সা:) বলেন- মানুষ যখন অনর্থক বিষয়াদি ত্যাগ করে তখন ইসলাম সৌন্দর্যমন্ডিত হয়।
৪) যারা যাকাতের পথে কর্মতৎপর হয়।
'' যাকাত দেয়া'' ও ''যাকাতের পথে সক্রিয় থাকার' মধ্যে অর্থের দিক দিয়ে বিরাট ফারাক আছে৷ একে উপেক্ষা করে উভয়কে একই অর্থবোধক মনে করা ঠিক নয়৷
মুমিনদের বৈশিষ্ট্য হিসাবে এখানে এর বিশেষ ধরনের অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।
আরবী ভাষায় যাকাত শব্দের দুটি অর্থ বিদ্যমান
১. পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা, পরিশুদ্ধি।
২. বিকাশ সাধনঃ কোন জিনিসের সাধনে যেসব জিনিস প্রতিবন্ধক হয়ে দাড়ায় সেসব দুর করা এবং তার মৌলবস্তুকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করা।
এই দুটি ধারনা মিলিয়ে যাকাতের পরিপূর্ণ ধারনা সৃষ্টি হয়। তারপর এই শব্দটি, ইসলামী পরিভাষায় ব্যবহৃত হলে এর দু’টি অর্থ প্রকাশ পায়-
১) এমন সম্পদ যা পরিশুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে বের করা হয়।
২) পরিশুদ্ধ করার মূল কাজটি
-- যদি বলা হয় পবিত্রতা তবে এর অর্থ হবে তারা সম্পদ পরিশুদ্ধির উদ্দেশ্যে সম্পদের একটি অংশ নেয়া।
-- কিন্তু যদি বলা হয় বিকাশ সাধন তবে তার অর্থ হবে তারা পবিত্রতা, পরিশুদ্ধতা তাযকিয়ার কাজ করছে। এ অবস্থায় ব্যাপারটি শুধুমাত্র আর্থিক যাকাত আদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং এর অর্থ ব্যাপক হবে। যেমনঃ
আত্মার পরিশুদ্ধি
চরিত্রের পরিশুদ্ধি
জীবনের পরিশুদ্ধি
তার পারিবারিক পরিশুদ্ধি
সে, সমাজ এবং রাষ্ট্রের পরিশুদ্ধি
অর্থের পরিশুদ্ধি
উপরোক্ত প্রত্যেকটি দিকের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত এর ব্যপ্তি ছড়িয়ে পড়বে। এছাড়া এর অর্থ কেবল নিজেরই জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে। না বরং নিজের চারপাশের জীবনের পরিশুদ্ধি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে পড়বে।
কুরআনের অন্যত্র সুরা সুরা আ’লাতে আল্লাহ বলেন, “কল্যাণ ও সফলতা লাভ করল সে, যে পবিত্রতার কাজ করলো এবং নিজের রবের নাম স্মরণ করে নামায পড়লো”
আল্লাহ আরো বলেন-
“সফলকাম হলো সে, যে নিজের নফসকে পবিত্র বা তাযকিয়া করলো। আর ব্যর্থ হলো সে যে নিজেকে কলুষিত করলো। এ আয়াতে গোটা সমাজ জীবনের কথা বলা হয়েছে।
৫) এবং যারা নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজত করে।
এর দু'টি অর্থ হয়৷ এক, নিজের দেহের লজ্জাস্থানগুলো ঢেকে রাখে৷ অর্থাৎ উলংগ হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করে এবং অন্যের সামনে লজ্জাস্থান খোলে না৷ দুই, তারা নিজেদের সততা ও পবিত্রতা সংরক্ষণ করে৷ অর্থাৎ যৌন স্বাধীনতা দান করে না এবং কামশক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাগামহীন হয় না৷
লজ্জাস্থানের হেফাজত অর্থ নিছক প্রবৃত্তির কামনা থেকে দূরে থাকা নয় বরং নিজের লজ্জাস্থানকে অন্যের সামনে উন্মুক্ত করা থেকে দূরে থাকাও বুঝা৷ পুরুষের জন্য সতর তথা লজ্জাস্থানের সীমানা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত নির্ধারণ করেছেন৷ তিনি বলেছেনঃ ''পুরুষের সতর হচ্ছর তার নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত''৷ (দারুকুত্নী ও বাইহাকী)
শরীরের এ অংশ স্ত্রী ছাড়া কারোর আমনে ইচ্ছাকৃতভাবে খোলা হারাম৷ আসহাবে সুফ্ফার দলভুক্ত হযরত জারহাদে আসলামী বর্ণনা করেছেন, একবার রসূলল্লাহু আল্লাইহি ওয়া সাল্লামের মজলিসে আমার রান খোলা অবস্থায় ছিল্ নবী করীম (সা) বললেনঃ '' তুমি কি জানো না, রান ঢেকে রাখার জিনিস'' (তিরমিযী, আবুদ দাউদ, মুআত্তা)
হযরত আলী (রা) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ ''নিজের রান কখনো খোলা রাখবে না৷''´(আবু দাউদ ও হবনে মাজাহ)
কেবল অন্যের সামনে নয়, একান্তেও উলংগ থাকা নিষিদ্ধ৷ তাই নবী করীম (সা) বলেছেনঃ
''সাবধান, কখনো উলংগ থেকো না৷ কারণ তোমাদের সাথে এমন সত্তা আছে যারা কখনো তোমাদের থেকে আলাদা হয় না( অর্থাৎ কল্যাণ ও রহমতের ফেরেশতা), তোমরা যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দাও অথবা স্ত্রীদের কাছে যাও সে সময় ছাড়া, কাজেই তাদের থেকে লজ্জা করো এবং তাদেরকে সম্মান করো৷''´(তিরমিযী)
অন্য একটি হাদীসে নবী করীম (সা) বলেনঃ-
''নিজের স্ত্রী ও ক্রীতদাসী ছাড়া বাকি সবার থেকে নিজের সতরের হেফাজত করো৷' এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করে, আর যখন আমরা একাকী থাকি? জবাব দেনঃ ''এ অবস্থায় আল্লাহ থেকে লজ্জা করা উচিত, তিনিই এর বেশী হকদার৷' (আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ)৷
এই সূরার ১০-১১ আয়াতে বলা হয়েছে, তারাই (এসবগুনের অধিকারীকেই) উত্তরাধিকার লাভ করবে। তারা উত্তরাধিকার হিসেবে ফেরদাউস পাবে এবং সেখানে চিরদিন থাকবে। এখানে উত্তরাধিকারী বলা হয়েছে এজন্য যে মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ যেমন উত্তরাধিকারদের নিশ্চিত প্রাপ্য। এবং গুনের অধিকারীদেরও জান্নাতে প্রবেশ সুনিশ্চিত। সফলকাম ব্যক্তিদের গুনাবলী পুরোপুরি উল্লেখ করার পর এই বাক্যে আরও ইঙ্গিত আছে যে পূর্ণাঙ্গ সফল জান্নাতী ব্যক্তি।
ফিরদাউস শব্দটি এসব ভাষায় এমন একটি বাগানের জন্য বলা হয়ে থাকে যার চারিদিকে পাচিল দেয়া থাকে। বাগানটি বিস্তৃত হয়। মানুষের আবাস গৃহের সাথে সংযুক্ত হয় এবং সব ধরনের ফল বিশেষ করে আঙ্গুর পাওয়া। কোন কোন ভাষায় এর অর্থের মধ্যে এ কথাও বোঝায় যে এখানে বাছাই করা গৃহপালিত পশু পাখি পাওয়া যায়।
কুরআনে বিভিন্ন সমষ্টিকে ফিরদাউস বলা হয়েছে।
“তাদের আপ্যায়নের জন্য ফিরদৌসের বাগানগুলি আছে।” এ থেকে মনের মধ্যে এ ধারনা জন্মে যে ফিরদৌস একটা বড় জায়গা, যেখানে অসংখ্য বাগ বাগিচা উদ্যান রয়েছে।
শিক্ষাঃ
১) নিছক পার্থিব ও বৈষয়িক প্রাচুর্য ও সম্পদশালীতা এবং সীমিত সাফল্যের নাম সফলতা নয়। আখেরাতের স্থায়ী সাফল্যই প্রকৃত সাফল্য।
২) খুশু খুযুর সাথে নামায আদায়।
৩) বাজে কথাও কাজে সময় নষ্ট না করা
৪) সর্ববস্থায় নিজেকে যাকাতের পন্থায় পরিশুদ্ধ করতে সচেষ্ট হওয়া।
৫) অবৈধ পন্থায় কাম প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার চিন্তাও না করা।
-সমাপ্ত-
Comments
Post a Comment